Breaking

April 17, 2022

ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য-Edul Fitorer Tatporjo

 ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য/Edul Fitorer Tatporjo


দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধানার পর, দীর্ঘ একমাস রোযা রাখার পর, রোযাদারদের জন্য খুশীর দিন হিসাবে আগমন করে ঈদুল ফিতরের দিন। “ঈদুল ফিতর" অর্থ রোযা খোলার আনন্দ, রোযা খোলার খুশী। এই আনন্দ এজন্যে নয় যে, এখন আর রোযা রাখতে হবে না, রোযা রাখার কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়া গেল, এখন আর কষ্ট করতে হবে না। বরং এই আনন্দের অর্থ হল আমরা দীর্ঘ একমাস আল্লাহ পাকের বড় একটা হুকুম-রোযা পালন করতে পেরেছি, এটা আমাদের জন্য বড় একটা আনন্দের বিষয়। আমরা যে আল্লাহ পাকের এতবড় হুকুম পালন করতে পেরেছি তার শোকর স্বরূপ, তার শোকর আদায় করার জন্য দুই রাকআত ঈদুল ফিরের নামাযও ওয়াজিব করা হয়েছে। ঈদের নামাযকে তাই শোকরের নামায বলা হয়। আমরা একমাস রোযা রাখতে পারলাম, এতবড় একটা আল্লাহর হুকুম পালন করতে পারলাম, এর জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করণার্থে আমরা দুই রাকআত নামায পড়ে নিব।

     এটাই হল ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য যে, আল্লাহর বড় একটা হুকুম পালন করতে পারার জন্য আমরা খুশী প্রকাশ করব, আনন্দিত হব। এর বাইরে সাধারণ ভাবে আমরা অনেকে বলে থাকি এবং বিভিন্ন বই-পত্রে এবং পত্র-পত্রিকায়ও লেখা হয় যে, ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য হল- এটা মহা মিলনের দিন, পরস্পরের একাত্ম হয়ে যাওয়ার দিন, ধনী-গরীব ভেদাভেদ ভুলে যাওয়ার দিন। তাইতো সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে মুসলমানরা সেদিন একে অপরের সাথে কোলাকুলি করে হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের একাত্মতা প্রকাশ করে। ধনী-গরীব রাজা-প্রজার ভেদাভেদ ভুলে সব এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামায পড়ে ইত্যাদি। এসব কথা আদৌ ঈদের তাৎপর্য নয়। এক কাতারে মুসলমানরা সব সময়ই নামায় পড়ে থাকে এবং পড়ার বিধানও আছে। ধনী-গরীবের ভেদাভেদ না রাখার নিয়ম সব সময়ের জন্যই। এরূপ ভেদাভেদ ইসলামে যেমন এই ঈদের দিনেও নেই, অন্য দিনেও নেই। রাজা-প্রজা একসাথে মিলে এক কাতারে নামায পড়বে এটা শুধু এই ঈদের দিনে কেন, সব সময়ই রাজা-প্রজা এক কাতারে নামায পড়বে। ইসলাম একথা বলেনি যে, অন্য সময় রাজারা গার্ড পরিবেষ্টিত হয়ে এমন স্বতন্ত্র জায়গায় নামায পড়বে, যেখানে গরীবরা যেতে পারবে না। আর কোলাকুলি করা, এটা ঈদের দিনের কোন বিধান নয়। ঈদের দিন কোলাকুলি করতে হয় বা করলে বিশেষ কোন ফজীলত আছে এমন কথা কোন কিতাব-পত্রে লেখা নেই। ঈদের দিনে কোলাকুলি করার নিয়ম আমরা তৈরি করে নিয়েছি। এটা এক ধরনের রছমে পরিণত হয়েছে। তাই ঈদের তাৎপর্য আমরা যা বলে আসছি, গভীর ভাবে চিন্তা-ভাবনা করলে দেখা যায় এগুলো আদৌ ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য নয়। বরং ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য হল – আমি আল্লাহর একটা বড় ইবাদত পালন করতে পেরেছি- এজন্য আমি খুশী, এজন্য আমি আনন্দিত।

     আবার এই আনন্দ প্রকাশও করছি একটা ইবাদতের মাধ্যমে। আল্লাহর একটা হুকুম পালন করতে পারার জন্য আনন্দিত হলাম, আবার সেই আনন্দ প্রকাশও করলাম আর একটা হুকুম পালন করার মাধ্যমে। বোঝা গেল - মু'মিনের আসল আনন্দ হল আল্লাহর হুকুম পালন করার মধ্যে। পার্থিব কোন সাফল্যের ভিত্তিতে মুমিনের আসল আনন্দ হতে পারে না। আমি যত বেশী আল্লাহর হুকুম পালন করতে পারব, তত বেশী আনন্দিত হব-এটাই হল মু'মিনের মানসিকতা। ইবাদত করতে পারার মধ্যে আনন্দ বোধ করাই হল মু'মিনের মানসিকতা। এর বিপরীত ইবাদত করতে কষ্ট বোধ হওয়াটা হল মুনাফেকদের মানসিকতা। যেমন কুরআন শরীফে জেহাদ প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ

 فرح المحلفون بمقعدهم خلاف رسول الله وكرهوا أن يجاهدوا بأموالهم وأنفسهم في سبيل الله (সূরা তওবা ৮১)

     অর্থাৎ, মোনাফেকরা জেহাদে না যেতে পারলে আনন্দ বোধ করে, আর জেহাদে যেতে কষ্ট বোধ করে। অর্থাৎ, যখন মুনাফেকদেরকে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদে বের হওয়ার হুকুম দেয়া হয়, এরকম একটা কষ্টকর দ্বীনী কাজের জন্য আদেশ দেয়া হয়, তখন তারা সেটা করতে কষ্ট বোধ করে। অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছেঃ

(সূরা তাওবা : ৩৮) – اثاقلتم إلى الأرض 

অর্থাৎ, তারা খুব ভরাক্রান্ত হয়ে যায়, দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে যায় যে, এখন জেহাদ করতে হবে, এটা কত কষ্টের বিষয়। এমনি ভাবে রোযা আসতে থাকলেও মুনাফেক শ্রেণীর লোকের মধ্যে সাংঘাতিক কষ্টবোধ আসে যে, সামনে একটা বিপদ আসছে, একমাস না খেয়ে থাকতে হবে। এভাবে দ্বীনের কাজ সামনে আসলে, আল্লাহর কোন কঠিন বিধান সামনে আসলে কষ্ট বোধ হওয়া- এটা হল মুনাফেকদের মানসিকতা। এর বিপরীত মু'মিনের মানসিকতা হল- ইবাদত সামনে আসলে তার আনন্দ লাগতে থাকবে।

     ইবাদত সামনে আসলে আনন্দ বোধ না হওয়া বরং মন ভারাক্রান্ত হয়ে যাওয়ার কারণ হল আমরা আখেরাতের পাওয়াকে বড় পাওয়া মনে করি না, বরং দুনিয়ার পাওয়াটাকেই বড় মনে করি। আল্লাহ পাক তাই বলেছেনঃ  

أرضيتم بالحيوة الدنيا من الأخرة ؟ (প্রাগুক্ত)

অর্থাৎ, তাহলে কি পরকালের তুলনায় দুনিয়াকে নিয়েই তোমরা তৃপ্ত ? দ্বীনের কাজে আনন্দ বোধ হবে তখন, যখন পরকাল আমার সামনে মুখ্য হয়ে থাকবে, যখন পরকাল আমার মূল বিষয় বলে বিশ্বাস থাকবে। যখন পরকাল আমার কাছে আসল হবে, তখন দ্বীনের কাজেও আমার আনন্দ বোধ হবে। কারণ তখন মনে হবে এটাই তো আসল কাজ করছি। পরকালের তুলনায় দুনিয়াতো কিছুই না। আল্লাহ পাক তাই এরপর বলেছেনঃ

 نما متاع الحيوة الدنيا في الاخرة إلا قليل - (প্রাগুক্ত)

অর্থাৎ, পরকালের তুলনায় দুনিয়ার এই ভোগ বিলাস তো খুবই নগন্য।

     যাহোক যা বলছিলাম ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য হল আল্লাহর হুকুম পালন করার মধ্যে আমরা আনন্দ বোধ করব। আমাদের আনন্দ প্রকাশ পাবে দ্বীনের কাজের মাধ্যমে। এটাই হল ঈদুল ফিতরের তাৎপর। তাই হাদীছে বলা হয়েছেঃ

 النسائم فرحنان - فرحة عند فطره وافرحة عند إلقاء ربه - (متفق عليه)

     অর্থাৎ রোযাদারের জন্য দুটো খুশী, একটা হল রোযা করতে পারার জন্য ঈদের দিনের খুশী আর একটা খুশী হবে যখন সে তার প্রভু আল্লাহ পাকের সাক্ষাত লাভ করবে। তখন আল্লাহ তাআলা বলবেন যে আমার বান্দা! তুমি আমার জন্য পানাহার বর্জন করেছিলে, আমার উদ্দেশ্যে তুমি রোয়া রেখেছিলে, আমিই তোমার পুরস্কার। আল্লাহ স্বয়ং নিজে রোযার পুরষ্কার হবেন। রোযার পুরস্কার কি হবে এ ব্যাপারে হাদীছে এসেছে আল্লাহ পাক বলেছেনঃ

 وأنا أحرى به - (متفق عليه)

     অর্থাৎ, আমি নিজে রোযাদারের পুরস্কার দান করব।

এ হাদীছের আর এক ব্যাখ্যা এই হতে পারে যে, আল্লাহ স্বয়ং নিজে রোয়ার পুরস্কার হবেন। আর আল্লাহ যখন আমার হয়ে যাবেন, তখন সব কিছুই আমার হয়ে যাবে। এ হাদীছের আর এক ব্যাখ্যা এও হতে পারে যে, আল্লাহর দিদার নছীব হবে। জান্নাতের মধ্যে সবচেয়ে বড় নিয়ামত হিসাবে গণ্য হবে আল্লাহর দিদার। সবচেয়ে আনন্দের, সবচেয়ে মজার এবং সবচেয়ে খুশীর বিষয় হবে আল্লাহর দিদার অর্থাৎ আল্লাহর সাক্ষাত, আল্লাহর দেখা। এ হাদীছের আর এক ব্যাখ্যা এও হতে পারে যে, আল্লাহ স্বয়ং নিজ হাতে রোযাদারের পুরস্কার দান করবেন। একথা বলে রোয়ার ফজীলত বোঝানো হয়েছে যে, রোয়া এত গুরুত্বপূর্ণ আমল যে, আল্লাহ স্বয়ং নিজ হাতে রোযাদারের পুরস্কার বন্টন করবেন। তাই এতবড় গুরুত্বপূর্ণ আমল করতে পারার জন্যই হল রোযাদারের খুশী।

     ঈদুল ফিতরের আসল খুশী হল রোযাদারদের জন্য। যারা রোযাদার নয়, তাদের খুশী হল রোযাদারদের দেখাদেখি খুশী। আসল খুশী তাদের জন্য নয়। আসল খুশী হল রোযাদারদের জন্য। গ্রাম দেশে কোন কোন স্থানে এটা নিয়ে একটু বাড়াবাড়িও হয়ে থাকে। দেখা যায় যারা রোযাদার নয়, ঈদুল নামাযে তাদেরকে সামনের কাতারে দাঁড়াতে দেয়া হয় না। ঘোষণা করা হয় যে, যারা রোষাদার তারা সামনের কাতারে আসেন, আর যারা রোযাদার নন তারা পিছনে চলে যান। এরূপ করা ঠিক নয়। এরূপ করলে যারা রোযা রাখতে পারেনি, তাদেরকে অপমান করা হয়। এভাবে মজলিসে কাউকে অপমান করার বিধান শরীয়তে নেই। যদি রোযা না রাখার ক্ষেত্রে কারও শরীয়ত সম্মত ওজর থাকে, তাহলে কেন তাকে অপমান করা হবে। আর যদি বিনা ওজরে কেউ রোযা ছেড়ে থাকে, তবুও এভাবে তাকে অপমানিত করলে হয়ত সে আরও বিগড়ে যেতে পারে। এতে করে সে হয়ত ভবিষ্যতে ঈদের জামাআতে আসাই ছেড়ে দিবে। তাই এরূপ করা ঠিক না। তবে আসল খুশী রোযাদারদের জন্য একথা ঠিক।

     রোযাদার তার খুশী প্রকাশ করবে মূলতঃ ঈদের নামাযের মাধ্যমে। তবে এর সাথে সাথে ভাল খাওয়া-দাওয়া, ভাল পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করা ইত্যাদির মাধ্যমেও খুশী করার সুযোগ এদিনে বাখা হয়েছে। এগুলি হল বাহ্যিক বা প্রাকৃতিক খুশী। ইসলামে এরূপ খুশীর বিধানও রাখা হয়েছে। কারণ ইসলামে অপ্রাকৃতিক ধর্ম নয়। কুরআনে কারীমে বলা হয়েছেঃ

فطرة الله التي فطر الناس عليها ، لا تبديل لخلق الله ، ذلك الدين القيم (সূরা রূমঃ ৩০)

 

     কুরআন শরীফের এ আয়াতে বোঝানো হয়েছে যে, ইসলাম হল প্রাকৃতিক ধর্ম। অর্থাৎ, প্রাকৃতিক চাহিদাকে ইসলামে অস্বীকার করা হয়নি। কিছুটা বাহ্যিক আনন্দ-ফুর্তিও মানুষের প্রাকৃতিক চাহিদা। কিছুটা হাসি-খুশীতে কাটানো মানুষের প্রাকৃতিক চাহিদা। সারাক্ষণ কেউ মনের উপর চাপ দিয়ে চলতে পারে না, ২৪ ঘন্টা কেউ গোমড়া মুখো হয়ে থাকতে পারে না। মানুষের জীবনে মাঝে মধ্যে আনন্দ ফূর্তির প্রয়োজন আছে, হাসি-খুশীর প্রয়োজন আছে। মাঝে মধ্যে চিত্ত বিনোদনের প্রয়োজন আছে। তবে আনন্দ-ফুর্তি, হাসি-খুশী, বিনোদন এই সব কিছু ইসলামের সীমানার মধ্যে থেকে হতে হবে, লাগামহীন ভাবে নয়। যেমন ইচ্ছা তেমন আনন্দ-ফূর্তি করা যাবে না, যেমন ইচ্ছা তেমন চিত্ত বিনোদন করা যাবে না। ইসলামের সীমানার মধ্যে থেকেই করা যাবে। রাসূল (সাঃ) আল্লাহর এত বড় নরী ছিলেন, তিনিও আনন্দ ফূর্তি করেছেন। বিবি আয়েশাকে নিয়ে তিনি দৌড় প্রতিযোগিতা করেছেন। এটা ছিল আনন্দ ফূর্তির অংশ হিসেবে। এই দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথমবার রাসূল (সাঃ) হেরে গেছেন। দ্বিতীয় বার শেষ জীবনের দিকে অনুরূপ দৌড় প্রতিযোগিতা করেছেন। তখন হযরত আয়েশা (রাঃ) মোটা হয়ে গিয়েছিলেন বিধায় তিনি হেরে গেছেন এবং রাসূল (সাঃ) জিতে গেছেন। তখন রাসূল (সাঃ) বলেছিলেনঃ আজ ঐ দিনের প্রতিশোধ নিলাম। এটা ছিল আনন্দ ফূর্তি স্বরূপ বা চিত্ত বিনোদন স্বরূপ। রাসূল (সাঃ) নাতী হাসান, হুছাইনকে ঘাড়ে চড়িয়ে নিজে ঘোড়ার মত চার হাত পা দিয়ে হেটেছেন। একবার হুছাইন (রাঃ) ঘাড়ে ছিলেন, আর রাসূল (সাঃ) মসজিদের ভিতরে ঐ রকম চার হাত পা দিয়ে হাটছিলেন। একজন লোক বালক হুসাইনকে লক্ষ্য করে বললঃ বাহ! কত সুন্দর ঘোড়া পেয়েছে হো রাসূল (সাঃ) বললেনঃ আরোহীটা কেমন তাওতো দেখতে হবে। এভাবে রাসূল (সাঃ) ফূর্তি করেছেন। একবার একজন মুসাফির রাসূল (সাঃ)-এর কাছে এসে বলল। আমি একজন মুসাফির লোক, আমার কোন বাহন নেই। তখন কার যুগে বাহন ছিল উঠ, ঘোড়া ইত্যাদি জানোয়ার। মুসাফিরটা বললঃ আমার কোন বাহন নেই, আমি সফর করতে পারছিনা। আমাকে একটা বাহনের ব্যবস্থা করে দিন। রাসূল (সঃ) বললেনঃ

 أنا حاملك على ولد ناقة -

অর্থাৎ, ঠিক আছে আমি তোমাকে একটা উঠনির বাচ্চা দিয়ে দিব। লোকটা বললঃ উঠনির বাচ্চা দিয়ে কি করব, আমারতো আরোহন করার যোগ্য বাহন চাই। রাসূল (সাঃ) বললেনঃ

 وهل تلك الابل إلا الشوق - (شامل ترندی )

অর্থাৎ, সব উঠতো উঠনির বাচ্চাই হয়। উঠনির বাচ্চা ছাড়া উঠ হয় কি করে ? এভাবে রাসূল (সাঃ) একটু রসিকতা করলেন। তবে রসিকতা করতে যেয়ে তিনি কোন মিথ্যা কিছু বলেন নি। এভাবে আনন্দ-ফুর্তির বিধান ইসলামে আছে তবে লাগামহীন নয়, নিয়ন্ত্রণের ভিতরে থাকতে হবে। কোন মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে, কারও আত্মমর্যাদায় আঘাত দিয়ে ফূর্তি করার বিধান ইসলামে নেই। আনন্দ ফূর্তির বিধান ইসলামে আছে, কিন্তু সেটা লাগামহীন নয়, নিয়ন্ত্রিত। আনন্দ ফূর্তি, হাসি-ঠাট্টা করতে যেয়ে মিথ্যার ভিতরে যেতে পারবে না, সত্যের সীমানার ভিতরে থাকতে হবে। আনন্দ-ফূর্তি করতে যেয়ে কারও আত্মমর্যাদায় আঘাত হানতে পারবে না। ইসলামে আনন্দ ফূর্তির বিধান আছে কিন্তু লাগামহীন নয়, যেমন খুশী তেমন আনন্দ ফূর্তি করার, যেমন খুশী তেমন চিত্ত বিনোদন করার বিধান ইসলামে নেই। কারও যদি মদ পান করে আনন্দ করতে ইচ্ছা করে ইসলাম তার অনুমতি দিবে না। কারও যদি ভবঘুরে মানুষের মত রাস্তায় এলোমেলো ঘুরতে আনন্দ লাগে, শরীয়ত তার অনুমতি দিবে না। অযথা সময় অপচয় করার অনুমতি শরীয়ত দেয়নি। কেউ যদি ছিনতাই করে, চুরি ডাকাতি করে আনন্দ করতে চায়, এর ভিতরেই তার আনন্দ বোধ হয়, ইসলামে তার অনুমতি নেই। কেউ যদি যেনা করতে চায়, ইসলামে তার অনুমতি নেই। কেউ যদি নাচ-গান করে চিত্ত বিনোদন করতে চায়, ইসলামে তার অনুমতি নেই। মোটকথা- ইসলামে আনন্দ ফূর্তি আছে, তবে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকতে হবে। মু'মিনের জীবনের সব কিছুই তো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে। দুনিয়াতে তারা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে, তাহলে আখেরাতে নিয়ন্ত্রণ মুক্ত জীবন লাভ করতে পারবে। তখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে। আর দুনিয়াতে যারা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে, আখেরাতে তাদের উপর চরম কঠিন নিয়ন্ত্রণ আসবে। শৃঙ্খলায় বেদে তাদেরকে জাহান্নামের নিয়ন্ত্রণে রাখা হবে। দুনিয়াতে একটু নিয়ন্ত্রণ মেনে চললে আখেরাতে বাঁধা বন্ধনহীন আনন্দ-ফূর্তির সুযোগ পাওয়া যাবে। কুরআনে এরশাদ হয়েছেঃ

 (সূরা হা মীম আস-সাজদাঃ ৩১) - ولكم فيها ما تشتهى أنفسكم ولكم فيها ما تدعون

 

অর্থাৎ, পরকালে জান্নাতে তোমাদের জন্য থাকবে যা তোমাদের মনে চায়। এর চেয়ে আর স্বাধীনতা কি হতে পারে যে, সে যা চাইবে তা-ই পাবে? দুনিয়াতে শরীয়তের লাগাম লাগিয়ে চলতে হবে, তাহলে পরকালে লাগামহীন খুশী পাওয়া যাবে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে এই তাওফীক দান করেন। আমরা যেন আল্লাহর হুকুমের ভিতরে নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করতে পারি, যেন আখেরাতে অফুরন্ত অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীন জীবন যাপন করতে পারি। আমীন!

আর তিনটা বিষয় জেনে নেই।

এক নম্বর সদকায়ে ফিতর-এর বিষয়ঃ সদকায়ে ফিতর বা ফিতরা (আরও পড়তে পারেন-সদকায়ে ফিতর/ফিতরা এর মাসায়েল) আসলে ওয়াজিব হয় ঈদের দিন সকালে। ঈদের দিন সুবহে সাদেক শুরু হলেই সদকায়ে ফিতর বা ফেতরা ওয়াজিব হয়। সদকায়ে ফিতর এদিন দেয়াই উত্তম। তবে যদি কেউ ঈদের আগে দিয়ে থাকেন, তাদের ফিতরাও আদায় হয়ে গেছে। মাদা পিছু ১ সের সাড়ে ১২ ছটাক গম বা আটা কিংবা তার মূল্য দিতে হয়। বর্তমান গ্রামের হিসেবে ১ সের সাড়ে ১২ দুটাকে ১ কেজী ৬৬২ গ্রাম হয়। এভাবে হিসাব করে দিতে হবে। সতর্কতার জন্য একটু বেশী দিয়ে দেয়াই ভাল।

     সদকায়ে ফিতর নাবালেগ সন্তানদের পক্ষ থেকে দেয়া ওয়াজিব। বালেগ সন্তানের পক্ষ থেকে দেয়া ওয়াজিব নয়। তবে যদি একান্নভুক্ত পরিবার হয়, তাহলে পিতা বালেগ সন্তানের জন্য দিয়ে দিতে পারেন। বরং দিয়ে দেয়াই উত্তম। স্ত্রীর ফিতরা স্বামীর উপরে দেয়া ওয়াজিব নয়, তবে দিয়ে দেয়া উত্তম। যদি স্ত্রীর উপরে ফিতরা দেয়া ওয়াজিব হয়ে যায়, তাহলে তো স্ত্রী নিজেই তার ফিতরা দিয়ে দিবে। চাকর-চাকরানীর পক্ষ থেকে ফিতরা দেয়া ওয়াজিব নয়।

     ফিতরা ওয়াজিব হয় ঐসব লোকদের উপরে, যাদের কাছে ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদেকের সময় যাকাত ওয়াজিব হওয়া পরিমাণ অর্থ/সম্পদ থাকে। তবে যাকাতের নেছাবের ক্ষেত্রে ঘরের আসবাব পত্র যা ঘরের মূল্য ইত্যাদি হিসেবে ধরা হয় না কিন্তু ফিতরার ক্ষেত্রে অভ্যাবশ্যকীয় ব্যতীত অন্যান্য আসবাবপত্র, সৌখিন দ্রব্যাদি, খালিঘর বা ভাড়ার ঘর (যার ভাড়ার উপর জীবিকা নির্ভরশীল নয়) এসব কিছুর মূল্য হিসেবে ধরা হবে। রোযা না রাখলে বা রাখতে না পারলে তার উপরও ফেতরা দেয়া ওয়াজিব। ফিতরা ঈদুল ফিতরের দিন ঈদের নামাযের পূর্বেই দিয়ে দেয়া উত্তম। নামাযের পূর্বে দিতে না পারলে পরে দিলেও চলবে।

    যাদেরকে যাকাত দেয়া যায় তাদেরকে ফিতরা দেয়া যায়। ঘরের চাকর-চাকরানী যদি বাস্তবে গরীব হয় তাহলে তাদেরকে যাকাত ফিতরা দেয়া যায়, তবে এটা তাদের বেতনের মধ্যে হিসাব করা যাবে না।

একজনের ফিতরা একজনকে দেয়া বা একজনের ফিতরা কয়েকজনকে দেয়া বা কয়েকজনের ফিতরা একজনকে দেয়া সব রকমই দোরস্ত আছে। তবে উত্তম হল একজনকে এই পরিমাণ দেয়া, যার দ্বারা সে ছোট-ঘাট প্রয়োজন পূরণ করতে পারে বা পরিবার পরিজনকে নিয়ে দু' তিন বেলা খেতে পারে।

    দুই নম্বর হল ছয় রোয়ার বিষয়ঃ শাওয়াল মাসে ছয়টা নফল রোযা (আরও পড়তে পারেন-শাওয়ালের ছয় রোজা-Shawaler Choy Roja) রয়েছে, সাধারণতঃ আমরা এটাকে ছয় রোয়া বলে থাকি। এই ছয় রোযার অনেক ফযীলত। রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ 

من صام رمضان ثم أتبعه ستا من شوال كان كصيام الدهر كله - (مسلم

অর্থাৎ, যারা রমযানের রোযা রাখে, এরপরে শাওয়াল মাসে ছয়টা রোযা রাখে, তাদের সারা বৎসর রোযা রাখার ছওয়াব হয়। এখানে শাওয়াল মাসে যে ৬ টা রোযা রাখার কথা বলা হয়েছে, তা শাওয়াল মাসের যে কোন সময় হতে পারে। এক সাথেও ছয়টা হতে পারে, মাঝে বিরতি দিয়েও হতে পারে। তবে বিরতি দিয়ে দিয়ে রাখাই উত্তম। এ হাদীছে বলা হল যে, রমযানের রোযা রাখার পর শাওয়াল মাসে ছয়টা রোযা রাখলে পুরো এক বছরের রোযা রাখার ছওয়াব হয়ে যায়। আল্লাহর কাছে হয়তো এরকম হিসাব আছে যে, প্রতিটা নেকী যেহেতু কম পক্ষে ১০ গুণ দেয়া হয়; অতএব রমযানের ৩০ টা আর শাওয়ালের ৬টা রোযা এই ৩৬ টাকে ১০ গুণ দিলে ৩৬০ টা হয়ে যায়। এভাবে রমযানের রোযার সাথে ছয় রোযা রাখলে পুরো এক বছরের রোযা রাখার ছওয়াব হয়ে যায়।

     তিন নম্বর বিষয় হল ঈদের নামায পড়ার নিয়মঃ ঈদুল ফিতরের দুই রাকআত নামায পড়া ওয়াজিব। এই দুই রাকআতে অতিরিক্ত ছয়টি তাকবীর বলা ওয়াজিব। যারা আরবীতে নিয়ত না জানি তারা এভাবে নিয়ত করব ঈদুল ফিতরের দুই রাকআত ওয়াজিব নামায অতিরিক্ত ৬টি তাকবীরসহ আদায় করছি। এরপর আল্লাহু আকবার বলে নিয়ত বাঁধা হবে। তারপর ছানা পড়া হবে। তারপর নামাযের তাকবীরে তাহরীমার ন্যায় কান পর্যন্ত হাত উঠিয়ে আল্লাহু আকবার বলতে হবে এবং হাত ছেড়ে দিতে হবে। তারপর তিনবার সোবহানাল্লাহ বলা যায় পরিমাণ বিলম্ব করে আবার অনুরূপ হাত উঠিয়ে আল্লাহু আকবার বলতে হবে এবং হাত ছেড়ে দিতে হবে। আবার অনুরূপ বিলম্ব করে হাত উঠিয়ে আল্লাহু আকবার বলে হাত বেঁধে নিতে হবে এবং আউয়ূ বিল্লাহ, বিসমিল্লাহ সহ সূরা ফাতিহা ও কেরাত ইত্যাদি সহকারে প্রথম রাকআত শেষ করে দ্বিতীয় রাকআতের জন্য উঠা হবে। দ্বিতীয় রাকআাতে প্রথমে সূরা ফাতেহা পড়ে তার সাতে সূরা/কেরাত মিলিয়ে তারপর প্রথম রাকআতের ন্যায় অতিরিক্ত তিনটি তাকবীর বলতে হবে। এখানে তৃতীয় তাকবীরের পরও হাত ছাড়া অবস্থায় থাকবে। তারপর রুকুর তাকবীর বলে রুকুতে যাওয়া হবে এবং যথা নিয়মে এই রাকআত শেষ করা হবে।

     নামাযের পর ঈদুল ফিতরের দুই খুতবা পাঠ করা হবে। এই খুতবা পাঠ করা সুন্নাত, তবে জুমুআর খুতবার ন্যায় এই খুতবা শোনাও ওয়াজিব। খুতবার সময় হাটা-চলা করা, কথা-বার্তা বলা বা খুতবা শুনতে ব্যাঘাত হয় এমন কোন কিছু করা নিষিদ্ধ। এ বিষয়টার প্রতি আমরা লক্ষ্য রাখি। আল্লাহ পাক আমাদেরকে সব কিছু সহীহ ভাবে করার তাওফীক দান করুন। আমীন!

 واخر دعوانا أن الحمد لله رب العلمين -

 বয়ান ও খুতবা-১ (৩৬২-৩৬৭)

আরো পড়তে পারেনঃ

রোজার গুরুত্ব

রোজা ভঙ্গের কারণসমুহ

রোজার মাকরুহসমূহ

রোজার কাফ্‌ফারা-র মাসায়েল

রোজার কাযার মাসায়েল

নফল রোজার মাসআলা/Nafal Rojar Masala

এতেকাফ-Etekaf-ইতেকাফ

এতেকাফ এর মাসাআলা/Etekaf er Masala/এতেকাফের শর্তসমূহ

যেসব কারণে এতেকাফ ফাসেদ তথা নষ্ট হয়ে যায় এবং কাযা করতে হয়

শবে কদর, এ'তেকাফ ও ফিতরা মাসআলা

শাওয়ালের ছয় রোজা

হজ্জের গুরুত্ব ও ফযীলত-Hajjer Gurutto o Fajilat

সদকায়ে ফিতর/ফিতরা এর মাসায়েল/sadkaye fittor/fitara er masayel

নামাজ ও যাকাত এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

কুরবানীর ইতিহাস, তত্ত্ব, ফাযায়েল ও মাসায়েল

লাইলাতুল কদরের ফজিলত

৫ টি কথায় সকল চাওয়া/ যেসব আমলে দ্রুত দোয়া কবুল হয়

তওবার নামাজ কিভাবে পড়তে হয়

ইবাদত কবূল হওয়ার শর্তাবলী ১ম পর্ব

ইসলাম ও ঈমানের দাওয়াত

নামাযের প্রয়োজনীয় দোয়াসমূহ

Popular Posts