শবে কদর, এ'তেকাফ ও ফিতরা প্রসঙ্গ
(রমজানের ৩য় জুমুআর বয়ান)
রমযানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর বা শবে কদর রাখা হয়েছে। এই শবে কদরের ফযীলত অন্য কোন উম্মতকে দেয়া হয়নি, শুধু এই উম্মতকেই দেয়া হয়েছে। এই উম্মতকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন শ্রেষ্ঠ উম্মত বানিয়েছেন। কিন্তু হায়াত দিয়েছেন কম। অন্যান্য উম্মত শত শত বছর হাজার বছর পর্যন্ত হায়াত পেত। এত দীর্ঘ সময় হায়াত পেয়ে তারা অনেক বেশী নেক আমল করতে পারত। এই উম্মত হায়াত পায় সেই তুলনায় কম। এই অল্প হায়াত পেয়েও যেন অন্যান্য উম্মতের চেয়ে বেশী নেকী অর্জন করতে পারে সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। যাতে অন্যান্য উম্মতের চেয়ে এই উম্মত নেকীতে পিছিয়ে। না থাকে। কারণ এই উম্মত তো শ্রেষ্ট উম্মত, তারা তো নেকীতে অগ্রগামী থাকবে, পিছিয়ে থাকবে না। লাইলাতুল কদর বা শবে কদর হল সেই সুযোগ লাইলাতুল কদর বা শবে কদর এই উম্মতের একটা
বৈশিষ্ট্য। নবী কারীম (সাঃ) বলেছেনঃ অন্যান্য উম্মতকে এই রাতের ফীলত দেয়া হয়নি। শবে কদরের অনেক ফজীলত তার মধ্যে একটা ফজীলত হল যা সূরা কদরের মধ্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বয়ান করে বলেছেনঃ
إنّا أنركنه في ليلة القدر -
অর্থাৎ, আমি লাইলাতুল কদরে কুরআন অবতীর্ণ করেছি। প্রথমে লওহে মাহফুজ থেকে কুরআান প্রথম আসমানে নাযিল হয়। লওহে মাহফুজ অর্থ সংরক্ষিত ফলক। সপ্তম আসমানের উপরে আছে লওহে মাহফুজ। এই লওহে মাহফুজে পৃথিবীর আদি থেকে নিয়ে অন্ত পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে এবং যা কিছু ঘটবে, সব কিছু আল্লাহ পাক লিখে রেখেছেন। এর মধ্যে কুরআনে পাকও লিখে রাখা হয়েছে। এই লওহে মাহফুজ থেকে কুরআন শরীফ শবে কদরে দুনিয়ার আসমানে অবতীর্ণ করা হয়। সেখান থেকে রাসুল (সাঃ)-এর ২৩ বছরের নবুয়তী যিন্দেগীতে বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজন মোতাবেক আস্তে আস্তে নাযিল হয়েছে। এ রাতে কুরআন নাযিল হওয়া এ রাতের ফজীলত বোঝায়। কারণ আল্লাহর বাণী এবং শ্রেষ্ঠ বাণী এই রাতে নাযিল হয়েছে। এর দ্বারা রমজান মাসেরও ফজীলত বোঝা যায়। এরপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وما أدرك ما ليلة القدر ليلة القدر خير من ألف شهر -
অর্থাৎ লাইলাতুল কদর কি, শবে কদরের ফীলত কি তাকি তুমি জান? শবে কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। অর্থাৎ শবে কদরে ইবাদত করা হাজার মাস ইবাদত করার চেয়েও বেশী ফজীলত রাখে। হাজার মাসে ৮৩ বছর চার মাস হয়। এ হিসেবে কেউ যদি জীবনে ১২ রমজানে লাইলাতুল কদরের অর্জন করতে পারে, তাহলে এক হাজার বছর ইবাদতের ফজীলত পেয়ে যাবে। আর কুরআন শরীফে একথা বলা হয়নি যে, শবে কদর হাজার মাসের সমান, বরং বলা হয়েছে হাজার মাসের চেয়েও উত্তম, হাজার মাসের চেয়েও শেষ্ঠ। অতএব কেউ জীবনে বারটা শবে কদর পেলে হাজার বছর ইবাদত করার চেয়ে বেশী ফজীলত অর্জন করতে পারবে। কত বেশী ফজীলত তা নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। আল্লাহর ভান্ডারে অভাব নেই, তিনি কত বেশী দিতে পারেন, তা আমরা কল্পনাও করতে পারব না। এভাবে এই উম্মত অল্প হায়াত পেয়েও অন্যান্য তন্মতের চেয়ে বেশী নেকী অর্জন করে অগ্রগামী হয়ে যেতে পারবে।
একবার রাসূল (সাঃ) সাহাবায়ে কেরামের সামনে আগের যুগের উম্মতদের বিভিন্ন ইবাদতের কথা বয়ান করছিলেন। তিনি বনী ইসরাঈলের এক ব্যক্তি এক হাজার বছর জেহাদে কাটিয়েছেন তা বয়ান করলেন। হযরত জাকারিয়া (আঃ), হযরত আইয়ূব (আঃ), হযরত হিজকীল (আঃ) ও হযরত ইউশা (আঃ) এই চারজন নবীর প্রত্যেকে ৮০ বছর করে আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়েছেন এটাও বয়ান করলেন। তখন সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে একটা হতাশা জাগল। তাদের মনটা ছোট হয়ে গেল যে, আমরা এত বছর হায়াতও পাব না আর এত ইবাদতও করতে পারব না। তাহলেতো অন্যান্য উম্মত অগ্রসর হয়ে যাবে আর আমরা পিছিয়ে যাব তখন এই সূরা নাযিল হল যে, ঐ যে একজন মানুষ সারা জীবনে হাজার মাস জেহাদে কাটিয়েছে, আমি তোমাদের জন্য প্রতি বছরে এমন একটা রাত দান করলাম যা হাজার মাস ইবাদত করার চেয়েও বেশী ফযীলত রাখে। যাহোক এ আয়াতে শবে কদরের একটা ফজীলত বর্ণনা করা হয়েছে।
শবে কদরের আর একটা ফযীলত হল বায়হাকী শরীফের হাদীছে আছেঃ
اذا كان ليلة القدر نزل جبرئيل في كنكية من الملكة يصلون على كل قائم أو قاعد بذكر الله عزوجل - (رواه البيهقي في شعب الايمان )
অর্থাৎ, শবে কদরে হযরত জিব্রাঈল (আঃ) ফেরেশতাদের বিরাট বাহিনী নিয়ে অবতীর্ণ হন এবং যারা এই রাতে ইবাদত করে তাদের জন্য রহমতের দুআ করতে থাকেন।
সূরা কদরের আয়াতঃ
سرل الملكة والروح فيها باذن ربهم من كل أمر الاية
এই আয়াতের একটা ব্যাখ্যা থেকে জানা যায় যে, এই রাতে বিশেষ এক ধরনের রহমতের ফেরেশতা নাযিল হয়। এ থেকে বোঝা যায় এ রাতটা বিশেষ একটা রহমতের রাত। অর্থাৎ, এ রাতে বান্দাদের প্রতি বিশেষ রহমত হয়ে থাকে। বোখারী এবং মুসলিম শরীফের হাদীছে এই রাতের আরও একটা ফজীলত বয়ান করা হয়েছে। রাসুল(সাঃ) এরশাদ করেনঃ
من قام ليلة القدر إيمانا واحيسابا غفر له ما تقدم بين دنيه ـ (الترعيب عن البخاري ومسلم)
অর্থাৎ যে ব্যক্তি শবে কদরে আল্লাহর উপরে বিশ্বাস রেখে ছওয়াবের আশায় এবাদত করে, তার
পূর্বের সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়।
এখন প্রশ্ন হল কোন রাত শবে কদর? হাদীছের বর্ণনা থেকে বোঝা যায়- রমযান মাসের যেকোন রাত শবে কদর হতে পারে। তবে বোখারী শরীফের এক হাদীছে বলা হয়েছেঃ
تحروا ليلة القدر في الوبر من العشر الأواخر من رمضان - (بخاری)
অর্থাৎ, তোমরা রমযান মাসের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে শবে কদর তালাশ কর। এ হাদীছে রমযানের ২১, ২৩, ২৫ ২৭ ও ২৯ এই বেজোড় রাতগুলোতে বিশেষ ভাবে শবে কদর তালাশ করতে বলা হয়েছে। আমরা শুধু ২৭ শে রাতকেই শবে কদর ধরে নিয়েছি। আমরা মনে করি শবে কদর মানেই ২৭ শে রাত। তাই শবে কদর উপলক্ষে যা কিছু ইবাদত করার তা একমাত্র ঐ ২৭ শে রাতেই করি, অন্য রাতে করি না। কিন্তু হাদীছে এমন কথা বলা হয়নি। বরং হাদীছের বর্ণনা থেকে বোঝা যায় শেষ দশকের যে কোন বেজোড় রাতে হতে পারে। এমনকি এক হাদীছে রমযানের প্রথম দশকের কথাও বলা হয়েছে। শায়খ মুহিউদ্দীন ইবনে আরাবী (রহঃ) রমযানের ১৩ এবং ১৮ তারিখে শবে কদর পাওয়ার কথা বলেছেন। হযরত ইমাম শাফিয়ী (রহঃ) ২১ রমযানের কথা বলেছেন। সব কিছু মিলালে বোঝা যায় যে, শবে কদর সব বছর এক রাতে নাও হতে পারে। কোন বছর ২১ শে হল, কোন বছর ২৩ শে হল, কোন বছর ২৫ শে হল কোন বছর ২৭ বা ২৯ শে হল। এভাবে যেকোন রাতে হতে পারে। তাই রমযানের সব রাতেই লাইলাতুল কদর তালাশ করা দরকার।
লাইলাতুল কদর বা শবে কদর উপলক্ষে আমাদের কি কি করণীয় ? কুরআন হাদীছের আলোকে এ রাতে আমাদের করণীয় হল:
১ নম্বর করণীয় হলঃ লাইলাতুল কদরের ফজীলত পাওয়ার উদ্দেশ্যে কিছু নফল ইবাদত করা। যেমন পূর্বে আলোচিত এক হাদীছে বলা হয়েছেঃ যে ব্যক্তি কদরের রাতে বিশ্বাসের সাথে এবং ছওয়াব অর্জন করার নিয়তে ইবাদত করবে তার অতীতের সব গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে। এ হাদীছ দ্বারা এক দিকে এই রাতের ফজীলতও বোঝা গেল যে, এ রাতে ইবাদত করা দ্বারা অতীতের সব গোনাহ মাফ হয়ে যায়, আবার এটাও বোঝা গেল যে, এ রাতের একটা করণীয় কাজ হল ইবাদত করা। তাই এই রাতের ফজীলত পাওয়ার জন্য আমাদেরকে এক নম্বর কাজ করতে হবে এই রাতে কিছু নফল ইবাদত করতে হবে। কিছু নফল নামায পড়তে হবে, তেলাওয়াত, যিকির-আযকার ইত্যাদি করতে হবে।
অনেকে খুব পেরেশান থাকেন যে, কদরের নামাযের নিয়ত কি হবে? কোন কোন সূরা দিয়ে পড়তে হবে? আমরা পরিষ্কার ভাবে জেনে নেই- এশার নামাযের পর থেকে নিয়ে সুবহে সাদেক পর্যন্ত যে নফল নামায় পড়া হয়, তাকে বলা হয় তাহাজ্জুদ। অতএব কদর উপলক্ষে ইশার পর থেকে নিয়ে সুবহে সাদেক পর্যন্ত যত নামায পড়া হবে, সেগুলোকে নফলও বলা যাবে, তাহাজ্জুদও বলা যাবে। তাই যদি কেউ নফলের নিয়ত করে নামায পড়েন তাহলেও চলবে, আবার যদি কেউ তাহাজ্জুদের নিয়ত করে পড়েন তাহলেও চলবে।
কদর উপলক্ষে বিশেষ কোন নিয়ত নেই বা অমুক অমুক সূরা দিয়ে পড়তে হবে এমনও কোন বাধাধরা নিয়ম নেই। কোন কোন বইতে লেখা আছে কদরের নামায অমুক অমুক সূরা দিয়ে পড়তে হয়, এটা নির্ভরযোগ্য নয়। ঘরের মা-বোনদেরকে আমরা এটা জানিয়ে দেই। তারা অনেকে মনে করেন কী নামায পড়ব? কদবের নামাযের নিয়ত জানিনা, কি কি সূরা দিয়ে পড়তে হয় তা জানি না। এজন্য তারা এই রাতে এবাদত ছেড়ে দেন। তাদেরকে জানিয়ে সেই যে, দুই দুই রাকাত নফল বা তাহাজ্জুদের নিয়ত করে যেকোন সূরা দিয়ে পড়লে চলবে। নফল নামায় দুই দুই রাকআত করে পড়া উত্তম। তাই দুই দুই রাকআত করে নফলের নিয়ত করে বা তাহাজ্জুদের নিয়ত করে পড়তে থাকতে হবে। যে কোন সূরা দিয়ে পড়া যাবে, কোন বাঁধাধরা নিয়ম নেই। যত রাকআত ইচ্ছা পড়তে পারবেন। তবে শুধু রাহাতের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ছোট ছোট সূরা নিয়ে পড়া বা তাড়াহুড়া করে রুকু সাজদা করা ভাল নয়। বরং উত্তম হল ধীরে সুস্থ্যে লম্বা লম্বা কেরাত পড়া এবং লম্বা লম্বা রুকু সাজদা করে আদায় করা। এতে রাকাআতের সংখ্যা কম হলেও নামাযের মান উন্নত হয়।
নফল নামাযের রাকআতের সংখ্যা বাড়ানোর চেয়ে মান বাড়ানোই বেশী উত্তম। এক্ষেত্রে কোয়ান্টিটির চেয়ে কোয়ালিটির গুরুত্ব বেশী। যাহোক কদরের রাতে আমাদের কি কি করণীয় এ প্রসঙ্গে একটা আমলের কথা বলা হল যে এ রাতে নফল নামায, তেলাওয়াত, যিকির-আযকার ইত্যাদি করতে হবে।
এ রাতের আর একটা আমল হল দুআ করা, বিশেষ ভাবে মাগফেরাতের দুআ করা অর্থাৎ, আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। হাদীছে এসেছে হযরত আয়েশা (রাঃ) বাসুল (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করেছিলেনঃ
ارأيت إن علمت أي ليلة ليلة القدر ما ذا أقول فيها " قال قولي اللهم انك عفو تحب العفو فاعت حتى - (رواه این مناحة والترمدی)
অর্থাৎ, ইয়া রাসুলাল্লাহ্। যদি আমি বুঝতে পারি কোন রাত শবে কদর, তাহলে ঐ রাতে আমি কি বলব? অর্থাৎ আল্লাহর কাছে কি চাইব? রাসূল (সাঃ) বললেনঃ তুমি বলবে হে আল্লাহ! তুমি বড়ই ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে তুমি ভালবাস, তাই আমাকে ক্ষমা করে দাও। এভাবে এই রাতে রাসূল (সাঃ) ক্ষমা চাওয়ার দোয়া শিক্ষা দিলেন যে, তুমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও, ক্ষমা পাওয়ার জন্য দুআ কর।
শবে কদর হল বৎসরের শ্রেষ্ঠ রাত। এই শ্রেষ্ঠ রাতের জন্য রাসূল (সাঃ) শ্রেষ্ঠ দুআ শিক্ষা দিলেন। শ্রেষ্ঠ দুআ হল ক্ষমা চাওয়ার দুআ। কারণ ক্ষমা পাওয়াই হচ্ছে মানুষের জীবনে সব চেয়ে বড় পাওয়া। কেউ যদি জীবনে অনেক কিছু পায় কিন্তু ক্ষমা না পায়, তাহলে তার জীবন ব্যর্থ। তাই আল্লাহর কাছে এই বিশেষ মর্যাদার রাতে ক্ষমা চেয়ে দুআ করতে বলা হয়েছে।
এই ক্ষমা চাওয়ার দুআ রাসূল (সাঃ)-এর শিখানো ভাষায় করতে পারলেই ভাল। যদি কারও এই আরবী দুআ মুখস্ত না থাকে, আর মুখস্ত না থাকবে কেন? এটা এমন কোন লম্বা চওড়া দুআ নয়, মাত্র কয়েকটা শব্দ। একান্তই যদি কারও মুখস্ত না হয়, তাহলে তিনি নিজের ভাষায় বলবেন যে, হে আল্লাহ! তুমি বড়ই ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে তুমি ভালবাস, তাই আমাকে ক্ষমা করে দাও। আল্লাহর কাছে অন্যান্য যা কিছু চাওয়ার চাইতে হবে, তার মধ্যে বিশেষ ভাবে আল্লাহর কছে ক্ষমা চাইতে হবে।
তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে আল্লাহর কাছে শুধু ক্ষমা চাইলেই ক্ষমা হয় না, খাঁটি দিলে তওবা এস্তেগফার করতে হয়। খাঁটি তওবা-এস্তগফারের জন্য ৪টা শর্ত।
এক নম্বর শর্ত হলঃ জীবনে যে সমস্ত গোনাহ হয়েছে তার জন্য মনে মনে অনুতপ্ত হতে হবে যে, আমি বড়ই অন্যায় করেছি। এমন অনুতপ্ত মন নিয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
দুই নম্বর শর্ত হলঃ যে গোনাহের জন্য আমি ক্ষমা চাইব ঐ গোনাহ্ এখন থেকে আমাকে ছেড়ে দিতে হবে। গোনাহ্ও করতে থাকব আর ক্ষমাও চাইতে থাকব- এরকম হলে তওবা-এস্তেগফার খাঁটি হবে না। বরং সেই গোনাহ এখনই ছেড়ে দিতে হবে।
তিন নম্বর শর্ত হলঃ ভবিষ্যতে ঐ গোনাহ আর করব না- মনে মনে এরকম দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিতে হবে, একরম মজবুত নিয়ত করতে হবে।
চার নম্বর শর্ত হলঃ বান্দার কোন হক নষ্ট করে থাকলে যথাসাধ্য সে হক আদায় করে নিতে হবে।
এভাবে চারটা জিনিস করা হলে খাঁটি তওবা হবে। এরপর আল্লাহর কাছে মাফ চাইলে আল্লাহ মাফ করবেন। যাহোক
এই রাতের দ্বিতীয় আমল হলঃ আল্লাহর কাছে বিশেষ ভাবে ক্ষমার জন্য দুআ করতে হবে।
এই রাতের তৃতীয় আমল হলঃ ফুকাহায়ে কেরাম বলেছেন যে, এই রাতে ইবাদতের পূর্বে যদি কেউ গোছল করে নিতে পারে তবে সেটাই উত্তম। এভাবে শবে কদরের ফজীলত অর্জন করার জন্য আমাদেরতে চারটা আমল করতে হবে। এই আমল গুলো ২৭শে রাতেই নয় বরং শেষ দশকের প্রত্যেক বেজোড় রাতে করতে হবে। রাসূল (সাঃ) আমাদরকে শুধু ২৭শে রাতে শবে কদর তালাশ করার কথা বলেননি বরং রমজান মাসের শেষ দশকের প্রত্যেকটা বেজোড় রাতেই শবে কদর তালাশ করতে বলেছেন।
এই লাইলাতুল কদর পাওয়াটা যেন অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায়। এজন্য রমজানের শেষ দশকে এ'তেকাফের বিধান (এতেকাফ এর মাসাআলা/Etekaf er Masala/এতেকাফের শর্তসমূহ)
রাখা হয়েছে। যারা শেষ দশকের পুরো দিন রাতগুলোতে এ'তেকাফ করবেন, তাদের কদর পাওয়াটা অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যাবে। যেহেতু তারা শবে কদর হওয়ার বিশেষ সম্ভাবনাময়ী পুরো দশদিনই আল্লাহর দরবারে পড়ে থাকবেন। এ'তেকাফের অর্থই হল পড়ে থাকা অবস্থান করা। যেন আল্লাহর দরবারে পড়ে থাকা হচ্ছে যে, যতক্ষণ দাবী আদায় না হবে, ততক্ষণ দরবারে পড়েই থাকব। পুরুষের জন্য যেমন এ'তেকাফের সুযোগ রয়েছে, মহিলাদের জন্যেও এ সুযোগ রয়েছে। এ'তেকাফ যেমন পুরুষরা করতে পারেন, মহিলারাও করতে পারেন। বরং মহিলাদের জন্য এ'তেকাফ করা বেশী সহজ। তারা ঘরের একটা কোণাকে নির্দিষ্ট করে সেখানেই এ'তেকাফের নিয়তে থাকবেন।
এ'তেকাফ শুরু হবে রমযানের একুশতম রাত থেকে। ২০শে রমজান দিন সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই এ'তেকাফের স্থানে চলে আসেতে হবে। এরপর ঈদের চাঁদ দেখা দিলে এ'তেকাফ শেষ হবে।
এ'তেকাফের অনেক ফজীলত। হাদীছে এসেছেঃ
من اعتكف يوما إبتغاء وجه الله جعل الله بينه بين النار ثلاث خنادق ابعد مما بين الحافين - (طبرانی في الأوسط والسبيقي)
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে খাঁটি দিলে একদিন এ'তেকাফ করবে আল্লাহ তাআলা জাহান্নামকে তার থেকে তিন খন্দক দূরে সরিয়ে দিবেন। এক “খন্দক" বলে বোঝানো হয় আসমান জমিনের যে দূরত্ব তার চেয়েও বেশী দূরত্বকে। এক দিনের এ'তেকাফ দ্বারা জাহান্নাম এরকম অনেক অনেক দূরে সরে যায়। আর জাহান্নাম তার থেকে দূরে সরে যাওয়ার অর্থ সে জান্নাতের কাছে চলে আসে। এ'তেকাফের ফজীলত বয়ান করে আরেক হাদীছে বলা হয়েছেঃ
المعتكف هو يعتكف الذنوب ، ويجرى له من الحسنات كعامل الحسنات كلها - (ابن ماجة)
অর্থাৎ এ'তেকাফকারী ব্যক্তি সর্ব রকম গোনাহ থেকে মুক্ত থাকে এবং তার জন্য এত বেশী নেকী লেখা হয় যেন সে সব প্রকার নেক কাজ করেছে। অর্থাৎ, এ'তেকাফ করার কারণে যেসব নেক কাজ সে করতে পারবে না যেমন জানাযায় শরীক হওয়া রোগী সেবা করা ইত্যাদি, এগুলোর ছওয়াবও সে পাবে। সার কথা হল এ'তেকাফ করলে লাইলাতুল কদর পাওয়াটা অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায়, এ'তেকাফ করলে জাহান্নাম বহু দূরে সরে যায়, এতেকাফ করলে যাবতীয় পাপ থেকে মুক্ত হওয়া যায়, এ'তেকাফ করলে যেসব নেক কাজ সে করতে পারবে না, সেসব নেক কাজ না করেও সে সেগুলোর ছওয়াব পেয়ে যাবে।
সব শেষে আর একটি বিষয়ের কথা জানা দরকার। যারা ফিতরা (আরও পড়তে পারেন-(সদকায়ে ফিতর/ফিতরা এর মাসায়েল/sadkaye fittor/fitara er masayel) দিতে চান, তাদেরকে জানতে হবে ফিতরা আসলে ওয়াজিব হয় ঈদের দিন সকালে। ঈদের দিন সুবহে সাদেক শুরু হলেই সদকায়ে ফিতর বা ফেতরা ওয়াজিব হয়। সদকায়ে ফিতর ঐদিন দেয়াই উত্তম। তবে যদি কেউ ঈদের দিনের আগেই দিয়ে নিতে চান দিতে পারেন। মাথা পিছু ১ সের সাড়ে ১২ ছটাক গম বা আটা কিংবা তার মূল্য দিতে হয়। বর্তমান গ্রামের হিসেবে ১ সের সাড়ে ১২ ছটাকে ১ কেজী ৬৬২ গ্রাম হয়। এভাবে হিসাব করে দিতে হবে। সতর্কতার জন্য একটু বেশী দিয়ে দেয়াই ভাল।
সদকায়ে ফিতর নাবালেগ সন্তানদের পক্ষ থেকে দেয়া ওয়াজিব। বালেগ সন্তানের পক্ষ থেকে দেয়া ওয়াজিব নয়, তবে যদি একান্নভুক্ত পরিবার হয়, তাহলে পিতা বালেগ সন্তানের জন্য দিয়ে দিতে পাবেন। বরং দিয়ে দেয়াই উত্তম। স্ত্রীর ফিতরা স্বামীর উপরে দেয়া ওয়াজিব নয়, তবে দিয়ে দেয়া উত্তম। যদি স্ত্রীর উপরে ফিতরা দেয়া ওয়াজিব হয়ে যায়, তাহলে তো স্ত্রী নিজেই তার ফিতরা দিয়ে দিবে। চাকর-চাকরানীর পক্ষ থেকে ফিতরা দেয়া ওয়াজিব নয়।
ফিতরা ওয়াজিব হয় ঐসব লোকদের উপরে, যাদের কাছে ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদেকের সময় যাকাত ওয়াজিব হওয়া পরিমাণ অর্থ/সম্পদ থাকে। তবে যাকাতের নেছাবের ক্ষেত্রে ঘরের আসবাব পত্র বা ঘরের মূল্য ইত্যাদি হিসেবে ধরা হয়না, কিন্তু ফিতরার ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় ব্যতীত অন্যান্য আসবাবপত্র, সৌখিন দ্রব্যাদি, খালিঘর বা ভাড়ার ঘর (যার ভাড়ার উপর জীবিকা নির্ভরশীল নয়) এসব কিছুর মূল্য হিসেবে ধরা হবে।
রোযা না রাখলে বা রাখতে না পারলে তার উপরও ফেতরা দেয়া ওয়াজিব। ফিতরা ঈদুল ফিতরের দিন ঈদের নামাযের পূর্বেই দিয়ে দেয়া উত্তম। নামাযের পূর্বে দিতে না পারলে পরে দিলেও চলবে। ঈদের দিনের পূর্বে রমজানের মধ্যে দিয়ে দেয়াও দুরন্ত আছে। যাদেরকে যাকাত দেয়া যায় তাদেরকে ফিতরা দেয়া যায়। ঘরের চাকর-চাকরানী যদি বাস্তবে গরীব হয় অর্থাৎ, যাকাত পাওয়ার যোগ্য হয়, তাহলে তাদেরকে যাকাত ফিতরা দেয়া যায়, তবে এটা তাদের বেতনের মধ্যে হিসাব করা যাবে না।
একজনের ফিতরা একজনকে দেয়া বা একজনের ফিতরা কয়েকজনকে দেয়া বা কয়েকজনের ফিতরা একজনকে দেয়া সব রকমই দোরস্ত আছে। উত্তম হল একজনকে এই পরিমাণ দেয়া, যার দ্বারা সে ছোট-খাট প্রয়োজন পূরণ করতে পারে বা পরিবার পরিজনকে নিয়ে দু' তিন বেলা খেতে পারে। এ সম্পর্কিত আরও যেসব মাসআলা রয়েছে, কিতাব পড়ে বা ওলামায়ে কেরাম থেকে জেনে নিয়ে সেভাবে আমল করতে হবে। কিতাব থেকে জানতে হলে "আহকামে যিনদেগী" (রমজান টপিকের পোষ্ট গুলো আহকামে যিনদেগী কিতাব থেকে সংকলিত) কিতাবখানা পাঠ করতে পারবেন। এভাবে প্রত্যেকটা মাসআলা জেনে আমরা আমল করব। আল্লাহ পাক আমাদেরকে আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
واخر دعوانا أن الحمد لله رب العلمين۔
সূত্রঃ বয়ান ও খুতবা (১) (৩৪৬-৩৫১)
নফল রোজার মাসআলা/Nafal Rojar Masala
যেসব কারণে এতেকাফ ফাসেদ তথা নষ্ট হয়ে যায় এবং কাযা করতে হয়
হজ্জের গুরুত্ব
ও ফযীলত-Hajjer Gurutto o Fajilat
ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য-EdulFitorer Tatporjo
নামাজ ও যাকাত এর
গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
কুরবানীর ইতিহাস,
তত্ত্ব, ফাযায়েল ও মাসায়েল