Breaking

April 20, 2022

কুরবানীর ইতিহাস, তত্ত্ব, ফাযায়েল ও মাসায়েল

 

কুরবানীর ইতিহাস, তত্ত্ব, ফাযায়েল ও মাসায়েল

 

ইসলামে অনেক ধরনের কুরবানী বা ত্যাগের বিধান রয়েছে। এক ধরনের কুরবানী হল জানের কুরবানী। যেমনঃ নামায, রোযা, হজ্জ, জেহাদ ইত্যাদির বিধান। এগুলি পালন করতে গেলে কিছুটা জানকে কষ্ট দিতে হয়, দেহকে কষ্ট দিতে হয়। এমনকি জেহাদে গেলে নিজের জীবনটাও চলে যেতে পারে। আর এক ধরনের কুরবানী হল মালের কুরবানী। যেমনঃ যাকাত, ফিতরা, কুরবানী, দান সদকা ইত্যাদির বিধান। এসব বিধান পালনের মাধ্যমে মালের কুরবানী দেয়া হয়। হজ্জের মধ্যে জানের কুরবানীও হয়, মালের কুরবানীও হয়। আর এক ধরনের কুরবানী হল মনের কুরবানী অর্থাৎ, মনের চাহিদার কুরবানী, মনের খাহেশ এবং চাহাতের কুরবানী। এই কুরবানীই হল সব চেয়ে বড় কুরবানী। কারণ, মানুষের পক্ষে জান-মাল ব্যয় করা সহজ অর্থাৎ, জান মালের কুরবানী দেয়া সহজ, কিন্তু মনের কুরবানী দেয়া কঠিন। মানুষ অকাতরে নিজের সম্পদ ব্যয় করতেও সহজে প্রস্তুত হয়ে যায়, কিন্তু নিজের মনের ধ্যান-ধারণা, নিজের মনের বুঝ, নিজের মনের যুক্তি সহজে ছাড়তে প্রস্তুত হয় না। রাসূল (সাঃ)-এর যুগে কাফেররা তাদের প্রচুর সম্পদ ব্যয় করেছে, এমনকি মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে নিজেদের জীবন পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছে, তবুও নিজেদের মনে কু শিরকের যে ধ্যান-ধারণা ছিল সেটা ত্যাগ করতে রাজী হয়নি। অর্থাৎ, সব কিছু কুরবানী দিতে তারা রাজি হয়েছে, কিন্তু মনের কুরবানী দিতে তারা রাজী হয়নি। দেখা গেল মনের কুরবানীটাই হল সব চেয়ে কঠিন।

     মনের কুরবানী হল সবচেয়ে বড় কুরবানী। সামনে ঈদুল আযহার যে কুরবানী আসছে, এখনে জানোয়ার জবাই করার মাধ্যমে মালের কুরবানী হবে, সেই সাথে মনেরও কুরবানী হবে। এই কুরবানীর জন্তু জবাই করতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে, এই অর্থের প্রতি মনের যে মায়া, সেই মায়াকে ত্যাগ করে কুরবানী করতে হবে। কুরবানী করতে গেলে মনের মধ্যে গোশত খাওয়ার চেতনাটাই মূল হয়ে দাঁড়াতে চাইবে, মনের এই চেতনাকেও কুরবানী দিতে হবে এবং সম্পূর্ণ আল্লাহকে রাজী খুশী করার নিয়তেই কুরবানী করতে হবে। কুরবানীর জন্তু কেনার সময় মনের মধ্যে আসবে সব চেয়ে দামী জন্তুটা কিনব, কিংবা যেটা কিনব সেটাকে সাজিয়ে পরিয়ে মহড়া দিব, তাহলে মানুষ জানবে যে অমুকে এই জন্তুটা কুরবানী দিতে যাচ্ছে। এভাবে মনের মধ্যে নাম শোহরতের চেতনা এসে যেতে চাইবে। মনের এই চেতনাকেও কুরবানী দিতে হবে। এভাবে জন্তু কুরবানীর সাথে সাথে মনেরও কুরবানী হবে। বরং মনের কুরবানীটাই হল আসল। কারণ, মনের এই সব গলত খেয়াল ত্যাগ না করলে এই কুরবানীর আমলে এখলাস থাকবে না। আর কোন আমলে এখলাস না থাকলে সেই আমলের কোনই মূল্য নেই। তাই মনের কুরবানী না করে শুধু রক্ত মাংসের জানোয়ার কুরবানী করলে তাতে কোন ফায়দা হবে না। কুরআনে কারীমে আল্লাহ পাক তাই এরশাদ করেছেনঃ

لن ينال الله لحومها ولا ديناؤها ولكن ينال التقوى منكم - (সূরা হজ্জঃ ৩৭)


     অর্থাৎ, এই কুরবানীর জন্তুর রক্ত মাংস আদৌ আল্লাহর কাছে পৌঁছে না বরং আল্লাহর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া অর্থাৎ, তোমাদের মনের এখলাস ও আন্তরিকতা।

হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর কাহিনী

     এই কুরবানীর বিধান প্রবর্তিত হওয়ার যে মূল ইতিহাস অর্থাৎ হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর পূত্রকে কুরবানী করার ঘটনা, সেখানেও মূল ছিল হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর মনের কুরবানী। তিনি আল্লাহর হুকুমে তাঁর কাছে দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় জিনিস পুত্রকে কুরবানী দেয়ার জন্য মন থেকে পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন। এটাই ছিল তার মনের কুরবানী। নিজের সন্তানের চেয়ে প্রিয় জিনিস দুনিয়াতে আর কি হতে পারে? সেই সন্তানকে কুরবানী দেয়ার জন্য আল্লাহ পাক হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে হুকুম দিয়েছিলেন তাও কেমন পুত্র প্রায় সারা জীবন হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ছিলেন নিঃসন্তান। সন্তানের জন্য আল্লাহর কাছে তিনি বারবার দুআ করছেন নিজের বয়স হয়ে গিয়েছে ১২০ বৎসর, স্ত্রীর বয়স হয়েছে ৯৯ বৎসর। এ অবস্থায় হল্লাহ পাক তাঁকে একটা সন্তান দান করলেন, নাম ইসমাঈল। তারপর ইসহাক নামে আর এক সন্তান লাভ করেন। এই পুত্র ইসমাঈল এর বয়স যখন ৭ বৎসর বা এক বর্ণনা মতে ১৩ বৎসর হল, তখন ইব্রাহীম (আঃ)কে স্বপ্নের মাধ্যমে আল্লাহ পাক আদেশ দিলেন তোমার সব চেয়ে প্রিয় বস্তুকে কুরবানী করে দাও।

     নবীদের স্বপ্ন হয় ওহী। তাই নবীগণ যা স্বপ্ন দেখেন তাতে কোন সন্দেহ থাকে না। নবীদের স্বপ্ন হল দলীল। তাই স্বপ্ন অনুযায়ী তিনি পুত্রকে কুরবানী করার জন্য প্রস্তুতি নিলেন। আমাদের স্বপ্ন দলীল নয়। তাই আমরা যদি এমন কোন স্বপ্ন দেখি যা শরীয়তে নেই, সেটা করা যাবে না। কেউ যদি স্বপ্ন দেখে অমুক মাজারে শিরণী দাও বা নজর নেওয়াজ দাও বা গরু ছাগল দাও, বা অমুক পুজা মন্ডপে সাপকে দুধ কলা দাও তাহলে এসব স্বপ্ন অনুযায়ী আমল করা যাবে না। কারণ মাজারে শিরণী বা নজর নেওয়াজ দেয়া জায়েয নয়। এমনি ভাবে পূজা মন্ডপে কিছু দেয়াও জায়েয নয়। কাজেই এসব স্বপ্ন অনুসারে কাজ করা যাবে না। তবে শরীয়তে জায়েয এমন কোন বিষয় যদি কেউ স্বপ্ন দেখে, তাহলে সে স্বপ্নের মূল্য আছে।

 

আমাদের স্বপ্ন দলীল নয়। কারণ ঘুমের মধ্যে আমাদের চেতনা ঠিক থাকে না। কি দেখেছি তা হয়ত সঠিক ভাবে মনে নেই বা সঠিক ভাবে তা বুঝতে পারিনি, কিংবা যা দেখেছি তা কি আল্লাহর পক্ষ থেকে দেখেছি না শয়তানের পক্ষ থেকে তারও গ্যারান্টি নেই। তাই আমাদের স্বপ্ন দলীল হতে পারে না। পক্ষান্তরে নবীগণ ঘুমালেও তাদের চেতনা সজাগ থাকে। হাদীছে এসেছেঃ নবীদের চোখ ঘুমায় কিন্তু তাঁদের অন্তর জাগ্রত থাকে। তাই তাঁরা স্বপ্নে কি দেখেছেন তা সঠিক ভাবে বুঝতেও পারেন, মনেও রাখতে পারেন। আর শয়তানের ওয়াছওয়াছা থেকেও আল্লাহ পাক তাদেরকে হেফাজতে রাখেন। তাই নবীগণের স্বপ্ন শরীয়তের দলীল হয়ে থাকে। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তাই স্বপ্নের আদেশ অনুযায়ী পুত্রকে কুরবানী করার জন্য মীনার ময়দানে নিয়ে গেলেন। কুরআন শরীফের সূরা সাফ্‌ফাত এর ১০২ নম্বর আয়াতে এসেছেঃ

হযরত ইব্রাহীম (আঃ) পুত্রকে বললেনঃ হে আমার প্রিয় ছেলে! আমি স্বপ্নে তোমাকে যবাই করার বিষয় দেখেছি, তুমি ভেবে দেখ এখন কি করণীয়। হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে পুত্রকে কুরবানী করার হুকুম এসেছে। পুত্র এতে রাজী না থাকলেও তিনি তা করবেনই। তারপরও তিনি পুত্রের কাছে জানতে চাইলেন পুত্রকে পরীক্ষা করার জন্য। নবীর পুত্র পরীক্ষায় ফেল করার নয়। কথায় বলে "বাপ কা বেটা সেপাহী কা ঘোড়া, কুছ না হো তো থাড়া খোড়া।" পুত্র জবাব দিলঃ

 قال بأنت افعل ما تؤمر ، ستجدني إن شاء الله من الشيرين - (প্রাগুক্ত)

অর্থাৎ, হে পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হচ্ছে তা-ই করুন, আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। রেওয়ায়েতে এসেছে- পুত্র আরও বললঃ হে আমার পিতা। আমাকে শক্ত করে বাঁধবেন, যাতে আমি নড়াচড়া করতে না পারি। নড়াচড়া করলে আপনার যবাই করতে কষ্ট হবে, আপনার পায়ে রক্ত ছিটে গিয়ে লাগবে। আর ছুরিটাকেও ভালভাবে ধারাল করে নিন, যাতে তাড়াতাড়ি যবাই সেরে ফেলতে পারেন। এভাবে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) পুত্রকে যবাই করার উদ্যোগ নিলেন। কুরআন শরীফে এসেছেঃ

 

فلما أسلما ولله للجبين ونادينه ان يا برهيم قد صدقت الرء يا انا كذلك نجرى المحسنين ، أن هذالهو البلاء المين ، وقدينه بديج عظيم(সূরা সাফফাতঃ ১০৩-১০৭)

অর্থাৎ, তারা পিতা পুত্র উভয়ে যখন আল্লাহর হুকুমের অনুগত্য করার জন্য নিজেদেরকে সোপর্দ করল, আর ইব্রাহীম পুত্রকে যবাই করার জন্য উপুড় করে শোয়ালো, তখন আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম যে, হে ইব্রাহীম। তোমার স্বপ্নকে তুমি বাস্তবে পরিণত করেছ। এটা ছিল এক মহা পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় তুমি উত্তীর্ণ হয়েছ। আল্লাহ বলেনঃ এভাবেই আমি নেককার লোকদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি। আল্লাহ পাক বলেনঃ আমি তার পুত্রের বদলে একটা মর্যাদাবান দুম্বা পাঠিয়ে দিলাম। জান্নাত থেকে এই দুম্বাটি আনা হয়েছিল।

হযরত ইব্রাহীম (আঃ) পুত্রের গলায় ছুরি চালিয়ে ছিলেন, কিন্তু দেখা গেল পুত্র যবাই হল না, তার স্থলে ঐ দুম্বাটি যবাই হয়ে গেল। এ ঘটনায় দেখা গেল পুত্র যবাই না হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ পাক বলেছেন ইব্রাহীম (আঃ) পরীক্ষায় পাশ করেছেন। বোঝা গেল পুত্রের কুরবানী হওয়াটাই পরীক্ষার মূল বিষয় ছিল না। বরং পরীক্ষার মূল বিষয় ছিল হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর মনের কুরবানী। তিনি যখন মন থেকে পুত্রকে কুরবানী করার জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত হলেন, আল্লাহর জন্য নিজের সব চেয়ে প্রিয় বস্তু পুত্রকে কুরবানী করতে উদ্যোগ নিলেন এবং প্রমাণ করলেন যে, আমি দুনিয়ার বস্তুর প্রতি আমার মনের সব ভালবাসা, মনের সব প্রেম আবেগ সব কিছুকে তোমার জন্য কুরবানী করে দিলাম। তখনই তিনি পরীক্ষায় পাশ হয়ে গেলেন। পুত্রের কুরবানী হয়ে যাওয়া আল্লাহর কাছে কাম্য ছিল না। যদি পুত্রের কুরবানী হয়ে যাওয়াই আল্লাহর কাছে কাম্য হত তাহলে পুত্রই কুরবানী হয়ে যেত। বরং আল্লাহর কাছে কাম্য ছিল হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর মনের কুরবানী।

হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর এই শিক্ষাকে ধরে রাখার জন্যই আমাদের উপরও কুরবানীর বিধান রাখা হয়েছে। হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) বলেন সাহাবায়ে কেরাম রাসুল (সাঃ)কে জিজ্ঞাসা করেছিলেনঃ

 

ما هذه الأسباحي يا رسول الله ؟ قال منه اسکم ابرهيم - الترغيب والترهيب)

অর্থাৎ, ইয়া রাসুলাল্লাহ্। এই কুরবানী কি? রাসুল (সাঃ) জওয়াবে বললেনঃ এটা হল তোমাদের পিতা ইব্রাহীম (আঃ)-এর আদর্শ। বোঝা গেল হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর মত মনের কুরবানী দিতে পারাই হল এই কুরবানীর শিক্ষা।

অতএব আমরা যদি আল্লাহর হুকুম পালন করার জন্য আমাদের মনের সব রকম জযবাকে কুরবানী দিতে পারি যেমনঃ সম্পদের মায়াকে উপেক্ষা করে আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ ব্যয় করতে পারি, সম্পর্ক সঞ্চয় করে রাখার মোহকে কুরবানী দিয়ে যাকাত দিতে পারি, হজ্জ করতে পারি, মানুষের ভালবাসার উপর, ছেলেমেয়ে এবং পরিবারের ভালবাসার উপর আল্লাহ আল্লাহর রাসুলের ভালবাসাকে প্রাধান্য দিতে পারি, এভাবে সব স্থানে মনের কুরবানী দিতে পারি, তাহলে কুরবানীর শিক্ষা আমার মধ্যে এসেছে বোঝা যাবে।


কুরবানীর জন্য কেমন জন্তু ক্রয় করতে হবে


কুরবানীর জন্য উত্তম জন্তু ক্রয় করতে বলা হয়েছে। যাতে বেশী অর্থ ব্যয় হয় এবং মন থেকে অর্থের মায়া-র কুরবানী হয়ে যায়। তাই কুরবানীর পশু ভাল এবং হৃষ্টপুষ্ট হওয়া উত্তম। ল্যাংড়া পা ভাষা, কান কাটা, লেজ কাটা, শিং ভাঙ্গা ও অন্ধ পশু দ্বারা কুরবানী জায়েয নয়।

কুরবানী করতে হবে একমাত্র আল্লাহর হুকুম পালন ও ছওয়াব অর্জন করার নিয়তে নাম শোহরতের ও মানুষকে দেখানোর নিয়তও থাকতে পারবে না। এই নাম শোহরতের জযবাকেও কুরবানী দিতে হবে। এমনকি গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে কুরবানী করলেও কুরবানী সহীহ হবে না। যদিও কুরবানীর গোশত খাওয়া জায়েয, কিন্তু কুরবানীর উদ্দেশ্য এটা থাকতে পারবে না। এ সমস্ত গলত নিয়ত থাকলে কুরবানী সহীহ হবে। না। এমনকি কয়েকজন শরীকে মিলে যদি একটা পশু কুরবানী করে, আর তাদের মধ্যে একজনের নিয়তও গলত থাকে, তাহলে সেই শরীকদের অন্য কারও কুরবানী সহীহ হবে না। তাই শরীক নেয়ার ক্ষেত্রে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। কারও সম্পর্কে যদি কোন ভাবে বোঝা যায় যে, তার নিয়ত সহীহ নয়, তাহলে তার সঙ্গে মিলে কুরবানী না করা চাই। এ বিষয়টি অত্যন্ত নাজুক শরীকদের প্রত্যেকের নিয়ত সহীহ থাকতে হবে। অন্যথায় কারুর কুরবানী সহীহ হাবে না, কুরবানীর ছওয়াবও পাওয়া যাবে না। সামান্য একটু গলত নিয়তের কারণে কুরবানীর এত বড় ছওয়াব নষ্ট করা হবে চরম বোকামী।


কুরবানীর করলে কত ছওয়াব হয়


কুরবানীর কত ছওয়াব- এ সম্পর্কে হাদীছে এসেছে। হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীছে এসেছেঃ

 قالوا فما لنا فيها يا رسول الله ؟ قال بكل شعرة حسنة قالوا:لشوف؟ قال بكل شعرة من الشوفحسنة-(الترغيب والترهيب)

অর্থাৎ, সাহাবায়ে কেরাম রাসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! কুরবানী করলে আমরা কি পাব? রাসূল (সাঃ) বললেনঃ প্রত্যেকটা চুলের বদলে এক একটা নেকী পাবে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন পশমের বদলেও কি হওয়ার পাওয়া যাবে? রাসুল (সাঃ) বললেনঃ প্রত্যেকটা পশমের বদলে এক একটা ছওয়াব পাওয়া যাবে। সোবহানাল্লাহ। তাহলে একটা কুরবানীর কত ছওয়াব। একটা পশুর গায়ে কত লক্ষ লক্ষ পশম থাকে তা কে গণনা করে দেখেছে। কুরবানীর এই ছওয়াবের দিকে তাকালে যাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়, তাদেরও কুরবানী অর্থাৎ, নফল কুরবানী করতে জযবা হওয়ার কথা। আর যাদের উপর কুরবানী করা ওয়াজিব, তাদেরতো অবশ্যই কুরবানী করতে হবে।

কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার জন্য অনেক টাকা-পয়সা থাকা জরুরী নয়। ঈদুল আযহার দিনগুলোতে যার কাছে যাকাত ওয়াজিব হওয়ার পরিমাণ অর্থ/সম্পদ থাকে, তার উপরই কুরবানী ওয়াজিব হয়ে যায়। এ হিসেবে কারও কাছে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্য পরিমাণ টাকা পয়সা থাকলেও অর্থাৎ, মোটামুটি টাকা থাকলেও তার উপর কুরবানী ওয়াজিব হয়ে যায়। আমাদের অনেকের কাছে এ পরিমাণ টাকা পয়সা থাকে এমন কি অনেক মা-বোনের কাছেও এ পরিমাণ অর্থ/সম্পদ থাকে। অথচ আমরা মনে করি না যে, আমাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব হয়েছে। কার কাছে কি পরিমাণ টাকা-পয়সা বা সোনা-রুপা আছে, বা কি পরিমাণ ব্যবসার মালামাল আছে, সেগুলো হিসেব করে প্রয়োজন হলে উলামায়ে কেরাম থেকে জেনে নিতে হবে আমার উপর কুরবানী ওয়াজিব কি-না। কুরবানী সম্পর্কিত অন্যান্য মাসায়েল কিতাব পড়ে বা উলামায়ে কেরাম থেকে জেনে নিতে হবে।

কুরবানী ওয়াজিব হয়ে থাকলে টাকা-পয়সার মায়াকে কুরবানী দিয়ে কুরবানী করতে হবে। সম্ভব হলে ওয়াজিবের বাইরেও নফল কুরবানী করার নিয়ম রয়েছে। মৃত মাতা-পিতার নামে, আপন জনের নামে, রাসূল (সাঃ)-এর নামে, তাঁর বিবিদের নামে আমরা নফল কুরবানী করতে পারি। দিল খুলে আমাদেরকে কুরবানী করতে হবে। এভাবে প্রচুর সংখ্যক কুরবানী হতে পারে।

ইসলামের জন্য যাদের দরদ নেই বা যারা ইসলামকে মনে প্রাণে পছন্দ করে না, তারা কুরবানীর দিনে এত সংখ্যক পশু কুরবানী হতে দেখে ভিতরে ভিতরে জ্বলতে থাকে এবং কুরবানী যেন কম হয় এজন্য তারা নানান যুক্তি পেশ করতে থাকে। কেউ কেউ বলে এই এক সময় যদি এত জানোয়ার জবাই না করা হত বরং সারা বৎসর আস্তে আস্তে জবাই হত, তাহলে সারা বৎসর বহু মানুষের পুষ্টির ব্যবস্থা হত। এই এক সময় এত পশু জবাই হওয়ায় সারা বৎসর পশুর ঘাটতি দেখা দিয়ে থাকে ইত্যাদি। তাদের এই যুক্তি ভুল বেশী ব্যবহার করলেই ঘাটতি দেখা দিবে এটা বাস্তবতা বিরোধী কথা বরং বাস্তব হল যে জিনিসের যত বেশী ব্যবহার হয়, তার উৎপাদনও তত বাড়তে থাকে। আর যার ব্যবহার যত কম, তার উৎপাদনও তত কম, একারণেই দেখা যায় কুকুর বিড়াল ইত্যাদি জানোয়ারের সংখ্যা কম কারণ এগুলোর ব্যবহার কম। এগুলো কেউ খায় না, তাই এদের সংখ্যাও তেমন বাড়ে না। অথচ বিড়াল কুকুর এক সাথে অনেকগুলো করে বাচ্চা দেয়। তবুও তাতে বরকত নেই। এর বিপরীত গরু ছাগল প্রতিদিন অনেক সংখ্যায় জবাই হয়, তবুও তার সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই থাকে। আল্লাহ পাকই বরকত দিয়ে থাকেন। তাছাড়া যে জিনিসের ব্যবহার যত বেশী হয়, মানুষও সেটা বেশী হারে উৎপাদনের দিকে মনোযোগ দিয়ে থাকে। কাজেই এ সমস্ত অপপ্রচারে প্রভাবিত না হওয়া উচিৎ। এগুলো ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার। এরকম অপপ্রচারে কান না দেয়া উচিৎ। দেল খুলে খুশী মনে কুরবানী করা উচিৎ। কুরবানীর ব্যাপারে রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ

قطيبوا بها نفسا - (ابن ماجه والترمدی)

 

অর্থাৎ, তোমরা খুশী মনে দিল খুলে কুরবানী করে যাও।

আল্লাহ পাক আমাদের মনের সব রকম ওয়াহওয়াছা দূর করে দেন। দিল খুলে কুরবানী করার তাওফীক দান করুন কুরবানীর জানোয়ার জবাই করা, গোশত বন্টন করা ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে ঈদুল আয্‌হার বয়ান পোস্টটি পড়তে পারেন।


কখন তাকবীরে তাশরীক পড়তে হয়


আর একটা বিশেষ মাসআলা শুনে নেই। ৯ই জিলহজ্জ ফজর থেকে শুরু করে ১৩ই জিলহজ্জ আসর পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্ত ফরয নামাযের পর তাকবীরে তাশরীক বলা ওয়াজিব। জামাআতে নামায হোক বা একাকী, সর্বাবস্থায় এটা বলতে হবে। পুরুষ হোক বা নারী সকলকে বলতে হবে। তাকবীরে তাশরীক হলঃ

الله اكبر الله أكبر لا إله الا الله والله أكبر الله أكبر ولله الحمد -

এই তাকবীর জোর আওয়াজে বলা ওয়াজিব। তবে মহিলারা আস্তে বলবে। নামাযের সালাম ফিরানোর সাথে সাথে এই তাকবীর বলতে হবে। ইমাম সাহেব যদি বলতে ভুলে যান, তাহলে মুক্তাদীগণ সালাম ফিরানোর সাথে সাথে বলবেন- ইমামের বলার অপেক্ষা করবেন না। ঈদুল আযহার নামাযের পরও এই তাকবীর বলা কারও কারও নিকট ওয়াজিব। তাকবীরে তাশরীক একবার বলা ওয়াজিব। তিনবার বলা সুন্নাত

ঈদুল আয্হার জামাআত ঈদুল ফিতরের তুলনায় একটু সকালেই হওয়া উত্তম। ঈদুল আয্হার দিনে যে সমস্ত সুন্নাত রয়েছে, সেগুলোও আমরা খেয়াল করে আমল করি। ঈদুল আযহার দিনে বিশেষ ১৩টা সুন্নাত রয়েছেঃ

 

ঈদূল আযাহার দিনের সুন্নাত


১ ভোরে খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠা।

২. মেসওয়াক করা

৩. গোসল করা।

৪ যথা সাধ্য উত্তম পোশাক পরিধান করা।

৫ শরীয়ত সম্মত ভাবে সাজ-সজ্জা করা।

৬. হুশবু লাগানো।

৭. ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে কোন কিছু না খাওয়া।

৮ আগে আগে যাওয়া।

৯. ঈদুল আযহার নামায় সকাল সকাল পড়া।

১০. পারলে ঈদগাহে যেয়ে ঈদের নামায পড়া উত্তম

১১. পায়ে হেটে ঈদগাহে যাওয়া।

১২ যাওয়ার সময় এই তাকবীর জোরে জোরে পড়তে পড়তে যাওয়া-

 الله أكبر الله أكبر لا إله الا الله والله اكبر الله اكبر ولله الحمد -

১৩. এক রাস্তায় যাওয়া, অন্য রাস্তা দিয়ে প্রত্যাবর্তন করা। আল্লাহ পাক আমাদেরকে সব কিছু সহীহভাবে আমল করার তাওফীক দিন। আমীন।

واحرد عوانا ان الحمد لله رب العلمين

 বয়ান ও খুতবা-১ (৪৪৮-৪৫৩)

আরো পড়তে পারেনঃ

রোজার গুরুত্ব

রোজা ভঙ্গের কারণসমুহ

রোজার মাকরুহসমূহ

রোজার কাফ্‌ফারা-র মাসায়েল

রোজার কাযার মাসায়েল

নফল রোজার মাসআলা/Nafal Rojar Masala

এতেকাফ-Etekaf-ইতেকাফ

এতেকাফ এর মাসাআলা/Etekaf er Masala/এতেকাফের শর্তসমূহ

যেসব কারণে এতেকাফ ফাসেদ তথা নষ্ট হয়ে যায় এবং কাযা করতে হয়

শবে কদর, এ'তেকাফ ও ফিতরা মাসআলা

শাওয়ালের ছয় রোজা

হজ্জের গুরুত্ব ও ফযীলত-Hajjer Gurutto o Fajilat

ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য-EdulFitorer Tatporjo

সদকায়ে ফিতর/ফিতরা এর মাসায়েল/sadkaye fittor/fitara er masayel

নামাজ ও যাকাত এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

লাইলাতুল কদরের ফজিলত

৫ টি কথায় সকল চাওয়া/ যেসব আমলে দ্রুত দোয়া কবুল হয়

তওবার নামাজ কিভাবে পড়তে হয়

ইবাদত কবূল হওয়ার শর্তাবলী ১ম পর্ব

ইসলাম ও ঈমানের দাওয়াত

নামাযের প্রয়োজনীয় দোয়াসমূহ

 

Popular Posts