Breaking

April 23, 2022

ইবাদত কবুল হওয়ার শর্ত ২য় পর্ব

 

ইবাদত কবুল হওয়ার শর্তাবলী ২য় পর্ব

 

ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য আর একটা শর্ত (ইবাদত কবূল হওয়ার শর্তাবলী ১ম পর্ব  চাইলে পড়ে নিতে পারেন) হল হালাল রিযিক। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা হুকুম দিয়েছেনঃ


يابها الرسل كلوا من الميت واعملوا صالحا ۔(সূরা মুমিনূনঃ  ৫১)

অর্থাৎ, হে মু'মিনরা! হালাল রিযিক গ্রহণ কর এবং নেক আমল কর। এ আয়াতের মধ্যে দু'টো কথা বলা হয়েছে। একটা হল হালাল রিযিক গ্রহণ করা। দ্বিতীয় হল নেক আমল করা তথা ইবাদত করা। এখানে প্রথমে হালাল রিযিক গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে, তারপর ইবাদতের কথা বলা হয়েছে। মুফাসসিরীনে কেরাম -যারা কুরআনের ব্যাখ্যা জানেন তারা বলেছেনঃ এই আয়াতে প্রথমে হালাল রিযিকের কথা তারপর নেক আমল বা ইবাদতের কথা বলে বোঝানো হয়েছে যে, ইবাদত বা নেক আমল কবুল হওয়ার জন্য হালাল রিযিক শর্ত। শর্ত আগে থাকে, তাই হালাল রিযিকের কথা আগে বলে বোঝানো হয়েছে যে, এটা হল শর্ত। হালাল রিযিক এত মৌলিক বিষয় যে, এক হাদীছে রিযিক হালাল না হলে জান্নাতেই যাওয়া যাবে না এমন কঠোর কথাও বলা হয়েছে। রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ 


لا يدخل الجنة جسد غذى بحرام -)رواه البيهقي في شعب الايمان – مشكوة

অর্থাৎ, হারাম রিযিক দ্বারা লালিত-পালিত দেহ জান্নাতে যেতে পারবে না। হালাল রিযিক যেহেতু ইবাদত কবূল হওয়ার একটা শর্ত, অতএব হারাম রিযিক গ্রহণ করলে ইবাদত কবূল হবে না। আর ইবাদত কবূল না হলে কিভাবে জান্নাতে যাওয়া যাবে ?

হারাম রিযিকের আরও অনেক রকম ক্ষতি আছে। হারাম রিযিক গ্রহণ করলে ইবাদত কবূল হয় না। এমন কি ইবাদত করার জযবা বা আগ্রহও সৃষ্টি হয় না। আমরা মুসলমান হিসেবে বুঝি যে, ইবাদত করা দরকার, জীবনের সব ক্ষেত্রে আল্লাহর হুকুম মানা দরকার, কিন্তু মানার জযবা আমাদের মধ্যে আসে না। এটা হয় রিযিক হারাম হওয়ার কারণে। এর বিপরীত হালাল রিযিক গ্রহণ করলে ইবাদতের জযবা পয়দা হয়। হারাম রিযিকের আরও ক্ষতি হল হারাম রিযিক দ্বারা দিল শক্ত হয়ে যায়, কলব গাফেল হয়ে যায়, ইবাদতে মজা লাগে না, কল্‌বে নূর পয়দা হয় না, আখেরাতের দিকে মন রুজু হয় না। হারাম রিযিক দ্বারা মানুষের কল্‌ব অন্ধকার হয়ে যায়। আর কল্‌ব অন্ধকার হয়ে গেলে দ্বীনের কথা ভাল বুঝে আসে না, সহীহ্ ইল্‌ম আসে না। আমরা অনেক সময় দ্বীনের কথা শুনি, কিন্তু মনে ধরে না, যুক্তিতে ধরে না, বিবেচনায় ধরে না, মনের অস্পষ্টতা কাটে না, এটাই যে সঠিক কথা এবং ভাল কথা- মনের ভিতরে এরকম পরিষ্কার ধারণা আসে না। এটা হারাম রিযিকের কারণে হয়। হালাল রিযিক গ্রহণ করা হলে, দ্বীনের কথা শুনলে ভাল বুঝে আসবে, কলবে নূর পয়দা হবে, যার ফলে যা শুনব মনের ভিতরে তা পরিষ্কার হয়ে উঠবে। দিলের মধ্যে এতমিনান এসে যাবে যে, এটাই সঠিক, এটাই যথার্থ। এরকম দিলের এতমিনান নিয়ে ইবাদত করলে ইবাদতে মজা লাগবে। কলবে আল্লাহর এশক মা'রেফাত পয়দা হবে। এভাবে হালাল রিযিকের অনেক ভাল প্রভাব আর হারাম রিযিকের অনেক খারাপ প্রভাব রয়েছে।

প্রত্যেকটা খাদ্য খাবারে আছর আছে, কিছু আছর হয় দেহের ক্ষেত্রে, যেমন এক এক ধরনের খাদ্য খাবারে দেহের এক এক ধরনের উপকার হয়। এমনি ভাবে খাদ্যের ভিতরে রূহানী প্রভাবও রয়েছে। এক এক খাদ্য খেলে রূহের ভিতরে এক এক রকম আছর হয়। শরীয়তে যত খাদ্য খাবার হারাম করা হয়েছে, তা একারণে হারাম করা হয়েছে যে, সেগুলো গ্রহণ করলে মানুষের আত্মার ভিতরে খারাপ প্রভাব পড়বে, তাদের চরিত্রের ভিতরে খারাপ প্রভাব পড়বে। ইসলাম যে খাদ্য খাবার গুলোকে হারাম করেছে, যেমন শুকরকে হারাম করেছে, সেগুলো খেলে মানুষের দৈহিক আত্মিক নানান রকম রোগ-ব্যাধি দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরাও এটা স্বীকার করেছে। শুকর নির্লজ্জ প্রাণী, তাই যারা শুকর খায় তারাও নির্লজ্জ হয়ে যায়। শুকর ভোজীরা এমনই নির্লজ্জ হয়ে যায় যে, মহিলাদের সাথে রাস্তা-ঘাটে আকাম কুকাম করতেও তাদের শরম লাগে না। এভাবে যতগুলো জিনিস খাওয়া শরীয়তে হারাম করা হয়েছে, সেগুলোর ভিতরে কোন না কোন স্বভাবগত খারাপ আছর রয়েছে।

যে সমস্ত রিযিক মানুষ হারাম পদ্ধতিতে উপার্জন করে, যেমন সুদের মাধ্যমে বা ঘুষের মাধ্যমে উপার্জন করে, এখানে তো শুরু থেকেই মানুষের স্বভাবে খারাবি এসে যায়। একজন মানুষকে বে-কায়দায় ফেলে বা তার অসহায়ত্বকে পূজি করেই সুদ ঘুষ নেয়া হয়। কেউ মনের খুশীতে সুদ ঘুষ দেয় না, একান্ত ঠেকায় পড়েই এগুলো দেয়। তাই তখনই সুদ ঘুষ গ্রহণকারীর অন্তর থেকে সহানুভুতি সমবেদনা দূর হয়ে যায়। এভাবে যত উপার্জনগত হারাম পদ্ধতি রয়েছে, সবটার ক্ষেত্রেই শুরু থেকে মানুষের স্বভাব খারাপ হয়ে যায়। শুরু থেকেই স্বভাবে খারাপ প্রভাব এসে যায়। যেমন মানুষের প্রতি অবিচারের মনোভাব, মানুষের প্রতি জুলুমের মনোভাব, নির্দয়তার মনোভাব ইত্যাদি খারাবী এসে যায়। শুরু থেকেই স্বভাব খারাপ হয়ে যায়। এভাবে শরীয়ত যত জিনিসকে হারাম করেছে, তার ভিতরে চরম খারাবি রয়ে গেছে। আমাদের বুঝে আসুক বা না আসুক। বুঝে না আসলেও আমাদেরকে মানতে হবে। যাহোক যা বলা হচ্ছিল যে, হারাম রিযিক গ্রহণ করলে ইবাদত কবূল হয় না। হালাল রিযিক গ্রহণ করা ইবাদত কবূল হওয়ার জন্য শর্ত।

 

কি ভাবে ইবাদত করতে হবে

 

ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য আরেকটা শর্ত হল সব ইবাদত সহীহ তরীকায় হতে হবে। কোন কিছু আমি আমার নিজের ইচ্ছামত করব না। সব কিছুর মাসলা-মাসায়েল জেনে, তরীকা জেনে সে ভাবে করব।। রাসূল (সাঃ) প্রত্যেকটা আমলের তরীকা বলে দিয়েছেন, দেখিয়ে গেছেন। সে ভাবেই করতে হবে। তাহলেই সেটা ইবাদত হবে। রাসূল (সাঃ) এক একটা ইবাদত করতেন আর বলতেন আমি যেভাবে করি এভাবে কর। যেমন নামায সম্পর্কে বলেছেনঃ


صلوا كما رأيتموني أصلي

অর্থাৎ, তোমরা আমাকে যেভাবে নামায পড়তে দেখেছ, সেভাবে নামায পড়বে। এখানে বোঝানো হল যে, নামায় তোমার নিজের খেয়াল খুশী মত পড়লে চলবে না। বরং আমি যেভাবে নামায শিক্ষা দিলাম সে ভাবে পড়তে হবে।

এক শ্রেণীর ভন্ডরা আছে যারা নামায পড়েনা, তারা বলে দিল ঠিক থাকলে সব ঠিক। দিল ঠিক থাকলে নামায পড়া লাগে না। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করি তাহলে রাসূল (সাঃ) কেন নামায পড়তেন, তার কি দিল ঠিক ছিল না? নাউজু বিল্লাহ। অনেক ভন্ডরা এরকমও বলে যে, আমরা কল্‌ব দিয়ে নামায পড়ি, অর্থাৎ, মন দিয়ে নামায পড়ি। এটাও গুমরাহীর কথা। নবী (সাঃ) কি বলে গেছেন যে, কল্‌ব দিয়ে নামায পড়! বরং রাসূল (সাঃ) এরকম বাহ্যিক নামায পড়েই তারপর বলেছেনঃ আমাকে যেমন নামায পড়তে দেখছ সেরকম নামায পড়। কলব দিয়ে নামায পড়লে কি নামায পড়া হয়? সেটাতো নামাযের কল্পনা হয়। কেউ যদি কুলব দিয়ে খায়, তাতে খাওয়া হয় না বরং খাওয়ার কল্পনা হয়। কুলব দিয়ে ঔষধ খেলে তাকে ঔষধ খাওয়া বলেনা, তাতে রোগ সারে না, বাস্তবে ঔষধ খেতে হয়। কুলব দিয়ে চাকুরী করলে তাতে বেতন পাওয়া যায় না, ফিজিক্যালী চাকুরী করতে হয়। তদ্রূপ কুলব দিয়ে নামায পড়লে তাতে নামায হয় না, তাতে নামাযের ছওয়াব পাওয়া যায় না। কিভাবে নামায পড়তে হবে তা রাসূল (সাঃ) আমাদেরকে দেখিয়ে গেছেন। কিভাবে হজ্জ করতে হবে তাও তিনি দেখিয়ে গেছেন এবং বলেছেনঃ


خذوا عني مناسککم ۔ (مسلم )

অর্থাৎ, তোমরা আমার থেকে হজ্জের নিয়ম নীতি গ্রহণ কর। অর্থাৎ, আমি যেভাবে হজ্জের আমলগুলো করেছি সেভাবে তোমরা হজ্জের প্রত্যেকটা আমল করবে। রাসূল (সাঃ) ছিলেন প্রাক্টিক্যাল মুয়াল্লিম বা বাস্তব প্রশিক্ষক। প্রাক্টিক্যালী তিনি সব কিছু শিক্ষা দিয়ে গেছেন। প্রত্যেকটা আমলের রূপ কি হবে, প্রত্যেকটা আমলের তরীকা কি হবে তা রাসূল (সাঃ)-এর মাধ্যমে আমরা জেনেছি। সেভাবেই প্রত্যেকটা আমল করতে হবে। কোন কিছু নিজের খেয়াল খুশী মত নয় বরং রাসূল (সাঃ)-এর শেখানো তরীকা মোতাবেক হতে হবে। তাই জানতে হবে যে, প্রত্যেকটা বিষয়ের ক্ষেত্রে রাসূল (সাঃ) এর তরীকা কি ছিল। অর্থাৎ, জানতে হবে প্রত্যেকটা বিষয়ের মাসলা-মাসায়েল কি? প্রত্যেকটা বিষয়ের মাসাআলা-মাসায়েল জেনে সে অনুযায়ী আমল করতে হবে, তাহলে সে আমল কবূল হবে।

আমরা অনেকে সারা জীবন ইবাদত করে যাচ্ছি- নামায পড়ছি, রোযা রাখছি, অন্যান্য ইবাদত করছি, কিন্তু মাসলা-মাসায়েল জানি না। গলত তরীকায় আমল করে যাচ্ছি। এভাবে যদি অস্পষ্টতা সহকারে আমল করতে করতে মৃত্যু এসে যায়, তাহলে আল্লাহর কাছে ধরা পড়ে যেতে হবে। সহীহ্ তরীকায় মাসলা-মাসায়েল অনুযায়ী না হলে ইবাদত কবূল হয় না। এজন্য মাসলা-মাসায়েল অর্থাৎ জীবনের প্রত্যেকটা আমল করার নিয়ম পদ্ধতি শেখাও ফরয। ইলম তলব করাকে ফরয করে দেয়া হয়েছে। জীবনের প্রত্যেকটা আমল, জীবনের সব কিছু কিভাবে করতে হবে সেটা জানা ফরয। হাদীছে আছেঃ


طلب العلم فريضة على كل مسلم - (ابن ماجة)

অর্থাৎ, প্রত্যেক মুসলমানের উপর ইলম তলব করা ফরয অর্থাৎ, শরীয়তের সব বিষয়ের মাসলা-মাসায়েল ও নিয়ম-পদ্ধতি শিক্ষা করা ও জানা ফরয। ইলম শিক্ষা করাকে ফরয় করে দেয়া হয়েছে, যেহেতু ইবাদত কবূল হওয়ার জন্য সঠিক তরীকা অনুযায়ী হওয়া শর্ত, আর ইল্‌ম ছাড়া সঠিক তরীকা অনুযায়ী হওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ পাক আমাদেরকে বোঝার এবং আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন!

আজকের আলোচনার সার সংক্ষেপ হল ইবাদত কবূল হওয়ার অনেকগুলি শর্ত রয়েছে। একটা শর্ত হল ইলাস। আর একটা শর্ত হল রিযিক হালাল হওয়া। আর একটা শর্ত হল নবীজী (সাঃ)-এর শিখানো তরীকা অনুযায়ী হওয়া অর্থাৎ, সহীহ্ তরীকা অনুযায়ী সহীহ মাসলা-মাসায়েল অনুযায়ী হওয়া। আল্লাহর পাক আমাদেরকে সব আমল সহীহ ভাবে করার তাওফীক দান করুন। আমীন!

واخر دعوانا ان الحمد لله رب العلمين –

 

 

আরো পড়তে পারেনঃ

রোজার গুরুত্ব

রোজা ভঙ্গের কারণসমুহ

রোজার মাকরুহসমূহ

রোজার কাফ্‌ফারা-র মাসায়েল

রোজার কাযার মাসায়েল

নফল রোজার মাসআলা/Nafal Rojar Masala

এতেকাফ-Etekaf-ইতেকাফ

এতেকাফ এর মাসাআলা/Etekaf er Masala/এতেকাফের শর্তসমূহ

যেসব কারণে এতেকাফ ফাসেদ তথা নষ্ট হয়ে যায় এবং কাযা করতে হয়

শবে কদর, এ'তেকাফ ও ফিতরা মাসআলা

শাওয়ালের ছয় রোজা

হজ্জের গুরুত্ব ও ফযীলত-Hajjer Gurutto o Fajilat

ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য-EdulFitorer Tatporjo

সদকায়ে ফিতর/ফিতরা এর মাসায়েল/sadkaye fittor/fitara er masayel

নামাজ ও যাকাত এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

কুরবানীর ইতিহাস, তত্ত্ব, ফাযায়েল ও মাসায়েল

লাইলাতুল কদরের ফজিলত

৫ টি কথায় সকল চাওয়া/ যেসব আমলে দ্রুত দোয়া কবুল হয়

তওবার নামাজ কিভাবে পড়তে হয়

ইসলাম ও ঈমানের দাওয়াত

নামাযের প্রয়োজনীয় দোয়াসমূহ

Popular Posts